অস্থির ঢাকাবাসী

0
763

সকালে গোসল করতে গিয়ে দেখেন পানি নেই। আবার কখনো কখনো ওয়াসার পাইপ দিয়ে বের হয় ময়লা আর দুর্গন্ধযুক্ত পানি। কর্মস্থলে যেতে বাসের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা। কোনো রকম বাসে উঠলে তীব্র যানজটে অস্বস্তি প্রায় প্রতিদিনের সঙ্গী। আবার গ্যাসের তীব্র সংকটে জ্বলছে না রান্নার চুলা। রাস্তাঘাট বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি আর উন্নয়ন কাজে ধূলিময় বাতাসে অন্ধকার চারপাশ। বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। শব্দ দূষণে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমন হাজারো সমস্যার বেড়াজালে জড়িয়ে আছে রাজধানীবাসীর জীবন ও জীবিকা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর জন্য দায়ী বিভিন্ন সংস্থা। যারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। ঢাকার চারপাশের নদীকে দূষিত করে এখন সেই পানি আবার পরিশোধন করা হচ্ছে। ঢাকাসহ পুরো দেশকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে ঢাকায় মানুষের সমাগম এত বাড়ত না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. সারওয়ার জাহান এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে কিছুটা সমস্যা সমাধান হলেও দীর্ঘ সময়ের সমাধান হয় না। উন্নয়ন করতে হবে। তবে সেটা দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে। ভাবতে হবে ২৫ থেকে ৩০ বছর পরের জনসংখ্যার কথা।

যানজট: যানজটে প্রতিদিনই ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের রাস্তায় সময় লাগে দু-তিন ঘণ্টা। সিটিং সার্ভিস নাম দিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে গলা কাটা ভাড়া আদায় করা হলেও দেখার কেউ নেই। ফলে সিটিং সার্ভিস নৈরাজ্য চলছেই। মুহিব উল্লাহ থাকেন লালবাগ এলাকায়। উত্তরায় তার এক ভাইয়ের বাসা। তাই তার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল ১০টায় গাজীপুরগামী ২৭ নম্বর পরিবহনে করে উত্তরায় পৌঁছান। এতে রাস্তায় তার সময় লেগেছে তিন ঘণ্টারও কিছু বেশি। যানজট নিয়ে বিড়ম্বনার কষ্ট কথা জানাচ্ছেন তারই এক বন্ধুর সঙ্গে নীলক্ষেতে। শুধু মুহিব উল্লাহ নন, রাজধানীর লাখ লাখ লোক প্রতিদিনই এমন যানজটের কবলে পড়েন। আর এভাবেই তাদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। রাজধানীতে যতগুলো সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে যানজট অন্যতম। এই সমস্যা ক্রমশ জটিল করে তুলেছে। আর নিত্যদিন এতে অতিষ্ঠ হচ্ছেন রাজধানীবাসী। রাজধানীর যানজট নিয়ে ২০১৬ সালে বুয়েট-এর পুরকৌশল বিভাগ এক গবেষণা চালায়। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটে ঢাকা সিটিতে বছরে আর্থিক হিসেবে ৩২ হাজার কোটি টাকার কর্মঘণ্টার ক্ষতি হয়। এই হিসেবে প্রতিদিন ৮৭ কোটি ৬৭ লাখ ১২ হাজার টাকা আর ঘণ্টা হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় ক্ষতি হয় ৩ কোটি ৬৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা। পুরকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান মানবজমিনকে জানান, ঢাকা শহরে প্রতিদিন যেকোনো পরিবহন মিলে মোট ২২ মিলিয়ন ট্রিপ দেয়া হয়। ট্রিপের গড় দূরত্ব ৫ দশমিক ৪ কিলোমিটার। প্রতি ট্রিপে ৩০ মিনিট করে দেরি ধরে এই হিসাব করা হয়েছে। তিনি জানান, তাদের গবেষণায় রাজধানীর মগবাজার থেকে কাকরাইল মোড় পর্যন্ত নেটওয়ার্ক ধরা হয়েছে। এতে পিক আওয়ারে অর্থাৎ বিকাল সোয়া ৬টা থেকে সোয়া ৭টা পর্যন্ত এই নেটওয়ার্কে প্রতি ঘণ্টায় রাস্তায় দেরি হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় আট লাখ টাকা। তাদের গবেষণার ২৩টি বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় যাত্রীদের কাছ থেকে। যাত্রীদের ৮৬ শতাংশ তাদের বাস যাত্রার অভিজ্ঞতার কথা খারাপ উল্লেখ করে তা উন্নত করার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সূত্র মতে, রাজধানী ঢাকায় সাড়ে ১০ লাখ অনুমোদিত যানবাহন চলাচল করছে অথচ ট্রাফিক বিভাগের হিসাবে সড়কের ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী ঢাকায় ৩ লাখের বেশি যানবাহন চলাচল করতে পারে না। বুয়েট-এর নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. সারওয়ার জাহান বলেন, স্বাধীনতার সময়ে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ। এখন দেড় কোটি। প্রায় ১০ গুণ জনসংখ্যা বেড়েছে। এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন যখন গাড়ি ব্যবহার করে তখন রাস্তায় চাপও বাড়ে। পাবলিক পরিবহন কম। রিকশায় যাতায়াত করছে মানুষ। রিকশা ও প্রাইভেট গাড়ি বেশি। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ গাড়ি নামছে রাস্তায়। এর বেশির ভাগই প্রাইভেট গাড়ি। প্রাইভেট কার ও রিকশা যানজট সৃষ্টি করে। এসব গাড়ি রাস্তা দখল করে একজন করে মানুষ নিয়ে যাচ্ছে। ৫০ জন, ৫০০ জন যেতে পারে এমন পাবলিক বাস কম। প্রাইভেট ও রিকশা কমাতে হবে। গণপরিবহন বাড়াতে হবে। ফ্লাইওভার দিয়ে সমাধান হবে না।

তীব্র গ্যাস সংকট: রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। কোথাও কোথাও ভোর ৭টার আগেই গ্যাস চলে যায়, আসে রাত ১২টার দিকে। নগরীর কোথাও গ্যাসের দেখা মিললেও দু-তিন ঘণ্টার মধ্যে আবার চলে যায়। কিছু এলাকায় চুলা জ্বলে নিভু নিভু। ফলে এক বেলা রান্না করে তিন বেলা খেতে হচ্ছে অনেক পরিবারকেই। অনেক গৃহিণী আবার গভীর রাতে রান্নার কাজ শেষ করে রাখেন। কেউ কেউ সিলিন্ডারের গ্যাসে রান্না-বান্না করতে বাধ্য হচ্ছেন। তীব্র গ্যাস সংকটে পাড়া-মহল্লার খাবারের দোকানে ভিড় করছে মানুষ। গ্যাস সংকটের কারণে গাড়ির গ্যাস নিতে সিএনজি ফিলিং স্টেশনে দীর্ঘ লাইন চোখে পড়েছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেকের ঘরে সপ্তাহ ধরে গ্যাস নেই। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে মিরপুরের মাজার রোড, বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, শেখেরটেক, বিশিল, টোলারবাগ, কলওয়েল পাড়া, রাইনখোলা, গুদারাঘাট, শাহ-আলী থানার ডি ব্লক, এফ ব্লক, সি ব্লক, রূপনগর আবাসিক এলাকা, শিয়ালবাড়ী, বেড়িবাঁধ, দারুসসালাম থানার বিভিন্ন ব্লকে গ্যাসের সংকট চলছে। এর বাইরেও মিরপুর ১২, কালসী, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, তালতলার কিছু কিছু ব্লকে গ্যাসের সমস্যার কথা জানান এলাকার বাসিন্দারা। তাদের বেশিরভাগের বাড়িতে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। এর মধ্যে কয়েকটি এলাকায় এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। দুপুরের পর যেসব বাড়িতে গ্যাস আসে তা আবার রাত ৮টার পরেই চলে যায়। গ্যাস সংকটে পড়ে অনেকের গৃহস্থালির কাজ করতে হয় ভিন্ন উপায়ে। কিছু কিছু বাসা সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করেছে। তবে নিম্ন আয়ের মানুষের সে সুযোগ নেই। টানা গ্যাস সংকটে পড়ে অনেকের আবার হোটেলের খাবারের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। পাইপলাইনে গ্যাস কম থাকায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন চাকরিজীবী মানুষ। এসব এলাকার শ্রমজীবীদের অবস্থাও একই রকম। তাদের রান্নার জন্য উঠতে হয় খুব ভোরে। ৬টার আগেই আবার গ্যাস চলে যায় বলে সব রান্নাবান্না এর আগেই সারতে হয়। এদিকে গ্যাস সংকটের কবলে পড়ে সিএনজি ফিলিং স্টেশনে দেখা যায় গাড়ির দীর্ঘ লাইন। মিরপুরের গুদারাগাটের বাসিন্দা নাদিরা বেগম বলেন, গত ১০/১২ দিন ধরে গ্যাসের সমস্যায় পড়ছেন। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠার আগেই গ্যাস চলে যায়। বিকেলে গ্যাস এলেও দুই তিন ঘণ্টা পরে পুনরায় চলে যায়। অনেক দিন ধরে রান্না করতে তার বেগ পেতে হচ্ছে। আবার এক বেলা রান্না করেও তাকে তিন বেলা খেতে হয়। মিরপুরের কয়েকটি সিএনজি স্টেশনের কর্মকর্তরা জানান, গত কয়েক দিন যাবত তাদের গ্যাস সরবরাহ করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে গ্যাস নিতে গিয়ে সিএনজি ড্রাইভারদের বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান বলেন, শীতের কারণে রাজধানীর বেশিরভাগ বাসাবাড়ির লোকেরা ঘর গরম রাখার জন্য প্রায় ২৪ ঘণ্টা চুলা জ্বালিয়ে রাখে। সে কারণেই ২৫০ মিলিয়ন ঘুনফুট বেশি গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে। তিনি আরো বলেন, এমনিতেই ৫০০ মিলিয়ন সরবরাহ কম থাকায় তাদের হিমশিম খেতে হয়। তার ওপর এখন আবার চাহিদা দাঁড়িয়েছে ৭৫০ মিলিয়ন ঘুনফুট। গ্যাসভিত্তিক একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানা বন্ধ না করা গেলে রাজধানীর এ সংকট কখনোই কমানো সম্ভব হবে না বলেও জানান তিনি।

পরিবেশ দূষণ: রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী। রাজধানীজুড়ে শুরু হয়েছে উন্নয়নমূলক কাজ। উন্নয়ন কাজ করতে দিনের পর দিন খুঁড়ে রাখা হচ্ছে রাস্তা। রাস্তার পাশের মাটি গাড়ির চাকায় মিশে ধূলিময় করছে পুরো এলাকা। রোদ উঠলেই ধুলার রাজ্যে পরিণত হচ্ছে রাজধানী। রাস্তায় ইট, খোয়া আর মাটির স্তূপ ক্রমেই উঁচু থেকে উঁচুতর হচ্ছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো খেয়ালখুশিমতো কাজ করায় এমন দুর্ভোগ। মিরপুরের শেওড়াপাড়া, রোকেয়া সরণি সেনপাড়া এলাকা দিয়ে চলছে ড্রেন ও ফুটপাথ নির্মাণ কাজ। রাস্তার ওপরেই খুঁড়ে রাখা হচ্ছে মাটি ও বালি। এ এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, রোদ উঠলে মাটি শুকিয়ে ধুলায় পরিণত হয়। আর রাস্তার পাশে বালির স্তূপ করে রাখায় বাতাসে উড়ে তা পৌঁছে যাচ্ছে বাসাবাড়িতে। অন্যদিকে মহানগরী ঢাকায় সহনীয় মাত্রার চেয়ে দেড়-দু’গুণ বেশি শব্দ বিরাজ করছে। শব্দ দূষণের কারণে উচ্চরক্তচাপ, অনিদ্রা, শ্রবণশক্তি হ্রাস, মনোসংযোগ কমে যাওয়া, মাথাব্যথা ও মাথা ধরার জটিলতায় ভুগছে নগরবাসী। শুধু তাই নয়, রাজধানীবাসীকে খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তি বোধসহ অস্বাভাবিক আচরণ করার মতো মানসিক ও দৈহিক নানা সমস্যার পড়তে হচ্ছে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরের, সিটি করপোরেশন, রাজউক, স্থানীয় সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সবার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) পরিচালিত বিভিন্ন স্থানের শব্দের মাত্রা পরিমাপের ভিত্তিতে পরিচালিত জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রাজধানীতে নীরব এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭৫ থেকে ৯৭ ডেসিবেল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দু’গুণ বেশি। আবাসিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭৬ থেকে ১০৭ ডেসিবেল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড়গুণের বেশি। মিশ্র এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭৩ থেকে ১০২ ডেসিবেল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড়গুণের বেশি। আর বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭১ থেকে ১০৭ ডেসিবেল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড়গুণ বেশি। উচ্চশব্দ শিশু, গর্ভবতী মা এবং হৃদরোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। আকস্মিক উচ্চশব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশীর সঙ্কোচন করে এবং পরিপাকে বিঘ্ন ঘটায়। পুরান ঢাকার লালবাগ-আজিমপুরের বাসিন্দারা দুর্গন্ধের কারণে মুখে তুলতে পারেন না ওয়াসার পানি। ওই এলাকার বাসিন্দা জুলফিকার আলী বলেন, অনেক সময় পানির পাইপ দিয়ে ময়লা বের হয়। পানিতে এতটাই দুর্গন্ধ যে ফুটালেও গন্ধ যায় না।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

eleven + 8 =