অভিনব কৌশলে প্রতারণা

0
1152

জেলে বসে বিদেশি অপরাধীর সঙ্গে বন্ধুত্ব। জেলেই অভিনব অপরাধের তালিম। এরপর জামিনে বের হয়ে প্রতারণা শুরু। সহজ-সরল মানুষকে উপহার কিংবা চাকরি দেয়ার ফাঁদে ফেলে প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছিল লাখ লাখ টাকা। প্রতারণার অভিযোগে রাজধানীর তেজতুরীপাড়া থেকে হেনরি ইসিয়াকা ও ইসমাইল হোসেন নামে দুই প্রতারককে শুক্রবার গ্রেফতার করে পুলিশ (পিবিআই)। তাদের গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। পিবিআই জানায়, নাইজেরিয়ান নাগরিক ইসিয়াকা ফুটবলার হিসেবে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসে। এরপর জড়িয়ে পড়ে প্রতারণায়। ছদ্মনামে ফেসবুকে সে বন্ধুত্ব করে উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণা করত। কৌশলে ফাঁদ পেতে সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে সে হাতিয়ে নিত লাখ লাখ টাকা।

এ ছাড়া অনলাইনে পাঠানো চাকরির আবেদনপত্র হ্যাক করে মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে চাকরি দেয়ার কথা বলে প্রতারণা করত। ২০১৬ সালে একটি প্রতারণার মামলায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিল ইসিয়াকা। ওই বছরের শেষের দিকে কারাগারে তেজগাঁও থানার তেজতুরী বাজার এলাকার ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে ইসিয়াকার পরিচয় হয়। জামিনে ছাড়া পেয়ে তারা বন্ধুদের নিয়ে প্রতারণা চক্র গড়ে তোলে। এ চক্রের কাজ হল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ইসিয়াকার প্রতারণা কাজে সহযোগিতা করা। শর্ত হল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকা জমা হলে অ্যাকাউন্ট হোল্ডার পাবেন ১০ হাজার টাকা, আর ইসিয়াকাকে ৯০ হাজার টাকা দিতে হবে। বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছিল এ চক্রের সদস্যরা। এ চক্রের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন মিরপুরের পশ্চিম কাফরুলের বাসিন্দা স্কুল শিক্ষিকা তাহমিনা পারভীন। উইলিয়াম ডেভিড নামে ফেসবুক আইডি থেকে ইসিয়াকা গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তাহমিনাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। তাহমিনা রিকোয়েস্টটি এক্সেপ্ট করলে দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। হোয়াটসঅ্যাপেও তাদের মধ্যে চ্যাটিং চলে। এরই মধ্যে তাহমিনার বাসার ঠিকানায় গিফট পাঠাতে চায় ইসিয়াকা। তাকে তাহমিনা বাসার ঠিকানা দেন। গত বছরের ৭ নভেম্বর তাহমিনার মোবাইল ফোনে ০১৭৩৭-০০৩৭৭০ নম্বর থেকে বেন কার্লুস পরিচয়ে একজন ফোন করেন। তাহমিনাকে জানানো হয়, ইউকে থেকে তার নামে একটা পার্সেল পাঠানো হয়েছে। ডেল্টা কুরিয়ার সার্ভিস লিমিটেডের মাধ্যমে উইলিয়াম ডেভিড পার্সেলটি পাঠিয়েছেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম কর্তৃপক্ষ পার্সেলের ডিউটি চার্জ বাবদ ৪৫ হাজার টাকা ডিমান্ড করেছে। এ জন্য ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কাওরানবাজার শাখায় এমডি সালাউদ্দিনের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে হবে। অ্যাকাউন্ট নম্বর পেয়ে সরল বিশ্বাসে তাহমিনা ১৭ অক্টোবর ডাচ্-বাংলা ব্যাংক মিরপুর ১০ নম্বর শাখা থেকে সালাহউদ্দিনের অ্যাকাউন্টে ৪৫ হাজার টাকা পাঠান। এর কিছুক্ষণ পর কার্লুস তাকে ফোন করে জানায়, উক্ত পার্সেলের ভেতরে অনেক পাউন্ড আছে, যা একজন সিনিয়র কাস্টমস অফিসারের নজরে আসায় পার্সেলটি ছাড় করতে অতিরিক্ত এক লাখ ৪০ হাজার টাকা দিতে হবে। টাকা সংগ্রহের জন্য তাহমিনা সময় চাইলে কার্লুস তাকে জানায়, ওই দিনের ব্যাংকিং সময়ের মধ্যেই দিতে হবে। তা না হলে তার নামে মানি লন্ডারিং মামলা হয়ে যাবে। একপর্যায়ে টাকা দিতে তাহমিনা রাজি হন। এ জন্য কার্লুস তাকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক রিং রোড শাখার এমডি আকরাম মুন্সির অ্যাকাউন্ট নম্বর দেন। তাহমিনা ওই অ্যাকাউন্টে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠান। টাকা পেয়ে কার্লুস জানায়, সময়মতো তিনি পার্সেল পেয়ে যাবেন। ১৮ অক্টোবর কার্লুস তাকে ফোনে আবারও জানায়, ওই পার্সেলের ভেতর এক লাখ পাউন্ড অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় এক কোটি সাত লাখ ৭৭ হাজার ৪৮০ টাকা ৩৯ পয়সা রয়েছে। মোট টাকার ৩ পার্সেন্ট ট্যাক্স জমা দিতে হবে, যা তিন লাখ ২৩ হাজার ৩২০ টাকা। তখন তাহমিনা ও তার ছেলে রাহাত (২০) কার্লুসের সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু সে দেখা করতে অসম্মতি জানায়। পরে তিনি বুঝতে পারেন প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিয়েছেন। তুরাগ থানার আহালিয়া এলাকার নাজিয়া তাবাসসুম শাওন জানান, গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তিনি মাস্টারমাইন্ড স্কুলসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে চাকরির আবেদন করেন। তার মোবাইল ফোনে একটি নম্বর থেকে ফোন করে ইংরেজিতে বলা হয়, মাস্টারমাইন্ড স্কুলে তার চাকরি হবে। এজন্য তাকে এক লাখ টাকা দিতে হবে। জনতা ব্যাংকের শ্যামলী শাখার সামসুদ্দিন মোহাম্মদ ইলিয়াসের অ্যাকাউন্ট নম্বর তাকে দেয়া হয়। ১৪ অক্টোবর জনতা ব্যাংকের উত্তরা মডেল টাউন শাখা থেকে ওই অ্যাকাউন্টে ৪০ হাজার টাকা পাঠান শাওন। এরপর তিনি ওই নম্বরটি বন্ধ পান। এতে তিনি বুঝতে পারেন প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। তাহমিনা ও শাওন দু’জনই পিবিআই’র দ্বারস্থ হন। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট নম্বর ও মোবাইল ফোনের কললিস্ট সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে পিআইবি। পিবিআই’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বশির আহমেদের নেতৃত্বে শুক্রবার দুপুর আড়াইটায় তেজগাঁও থানার পূর্ব তেজতুরীপাড়া থেকে ইসিয়াকা ও ইসমাইলকে গ্রেফতার করে। তবে সালাহউদ্দিন ও আকরাম মুন্সী পলাতক রয়েছে। এ বিষয়ে পিবিআই’র উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. হুমায়ূন কবির মোল্লা বাদী হয়ে কাফরুল থানায় একটি মামলা করেছেন। এই প্রতারক চক্র বিভিন্ন ব্যাংকে একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ লোকদের প্রতারিত করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে পিবিআই। সালাহউদ্দিনের অ্যাকাউন্টে ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। ইসমাইল ওই টাকা উত্তোলন করে তাদের ভাগের ১০ পার্সেন্ট রেখে বাকি টাকা ইসিয়াকার হাতে তুলে দেয়।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

two × one =