মোঃ আখতার রহমানঃ
রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় এবছর আমের মুকুল আশাতীত। কবিগুরুর সেই গানটি ‘বনে বনে ফুল ফুটেছে দোলে নবীন পাতা…’ এখন দিব্যি চোখে পড়ে….। কানে শোনার নয়, চোখে দেখার । পথের মাঝখানের বিভক্তি বরাবর যে গাছপালা এত দিন হতশ্রী অবস্থায় প্রেতের মতো চেহারা নিয়ে বিব্রত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা যেন ঝলমল করছে ফাল্গুনী হাওয়ার খুশিতে। সারি সারি আমগাছে এখন হলুদ আর সবুজের মিলনমেলা। গাছে গাছে শোভা পাচ্ছে স্বর্ণালী আমের মুকুল। যেমন তার সৌন্দর্য, তেমনি তার ঘ্রাণ। মুকুলের মৌ মৌ ঘ্র্রাাণে মাতোয়ারা মৌমাছির দল।
ভাষায় ফোটানো না গেলেও আমের গাছে এমন মুকুল ফোটা দৃশ্য এখন রাজশাহীর গ্রামে-গঞ্জে। আমের মুকুলে দোল দিচ্ছে চাষীর ‘স্বপ্ন’। আর ক’দিন পরেই আম গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিবে গুটি। সব কিছু ভেবে মুনাফার আগাম বার্তায়, পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। যারা বাগান ইজারা নিয়েছেন, তারা গাছের পরিচর্যায় আরও বেশি মনোযোগী। বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন রাজশাহীর আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা।
জেলার প্রায় সব এলাকাতেই রয়েছে বড় বড় আমবাগান। প্রতিবছরই আমবাগানের সংখ্যা বাড়ছে। বাগান আর সুস্বাদু ও বাহারি জাতের আমের কথা উঠলেই চলে আসে আমের রাজধানী খ্যাত রাজশাহীর বাঘা-চারঘাটের নাম।
কৃষি বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তোতাপরি,বৌভুলানী, রানীপছন্দ, জামাইখুসি, গোপাললাড়–, ফজলি, ল্যাংড়া, হিমসাগর, গোপালভোগ, লক্ষনা, বোম্বাই খিরসা, দাউদভোগ, গোপালভোগ, আ¤্রপালি, আশ্বিনা, ক্ষুদি খিরসা, বৃন্দাবনী, লক্ষ্মণভোগ, কালীভোগসহ প্রায় আড়াইশ’ জাতের আম উৎপন্ন হয় এখানে। তবে ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত, বোম্বাই, হিমসাগর, ফজলি, আ¤্রপালি, আশ্বিনা, ক্ষুদি, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ, কালীভোগ, তোতাপরী, দুধসর, লকনা ও মোহনভোগ জাতের আম বেশি চাষ হয়েছে। বাহারি জাতের আম দেশের কোটি কোটি মানুষের রসনা মেটানো ছাড়াও বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে। উপজেলায় ৮ হাজার ৩৬৮ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। ইতোমধ্যে ৯০ ভাগ গাছে মুকুল এসে গেছে।
আঞ্চলিক প্রবাদ রয়েছে, ‘আমের আনা মাছের পাই, টিকলে পরে কে কত খাই।’ তাঁদের মতে, গাছে গাছে যে পরিমাণ মুকুল এসেছে, তাতে সিকিভাগ টিকে গেলেও আমের বাম্পার ফলন হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হওয়া সাপেক্ষে এবার আমের বিক্রি গতবারের চেয়ে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন আম বাগানের মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
আমের মৌসুমে বাঘা-চারঘাট এলাকায় ছোট-বড় মিলে প্রায় তিন শতাধিক আমের বাজার বসে। প্রতিবছর আম মৌসুমে উপজেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
বাগান মালিক সূত্রে জানা গেছে, গাছে মুকুল আসার আগে থেকে আম পাড়া পর্যন্ত প্রায় ১০ থেকে ১৫ বার কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। তাতে হেক্টরে প্রায় সোয়া লক্ষ টাকার বালাইনাশক প্র্রয়োগ করা হয়। সে হিসেবে বাঘায় ৮ হাজার ৩৬৮ হেক্টর জমির আমগাছে বছরে ৩ কোটি টাকার কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহার হয়ে থাকে।
উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের আমচাষি মহসিন আলী জানান, আম গাছে কীটনাশক ও ছত্রাক নাশক প্রয়োগ, সার ও সেচ প্রদানসহ গাছের পরিচর্যা ছাড়া আমচাষিদের এখন অন্য কিছু করার ফুরসত নেই। মুকুল পুরো ফোটার আগে গাছে ডায়াথেন এম ও কনফিডর পরিমাণমতো পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা হয়েছে, যেন মুকুলে কোনো ধরনের পোকার আক্রমণ না হয়। আবার গুটি ধরার পর আরেক দফা স্প্রে করা হবে।
মনিগ্রাম এলাকার আম ব্যবসায়ী জিল্লুর রহমান জানান, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গাছে পর্যাপ্ত মুকুল এসেছে। এই মুহূর্তে শিলাবৃষ্টি হলে আমের মুকুলের ব্যাপক ক্ষতি হবে। এর উপর সামনে ঝড়-ঝঞ্জার সময়ও আসছে। তাই আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে বর্তমানে শঙ্কিত রয়েছেন। তবে পরিস্থিতি অনূকূলে থাকলে এবার বাম্পার ফলন হবে বলে জানান তিনি।
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাবিনা বেগম জানান, আগামী দিনগুলোয় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এখান থেকে সব জাতের আম মিলিয়ে এবার বাঘায় ২ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আম চাষ করলে এর উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি সঠিকভাবে সংরক্ষণ, পরিবহন, রপ্তানিসহ বাজারজাতকরণ করলে আয়ও বাড়বে। পাশাপাশি আমের স্বাদসহ গুণগতমানও বাড়বে।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার গাছে খুব একটা কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়াজন নেই। কিন্তু পাউডারি মিলডিউ নামে এক প্রকার ছত্রাকজনিত রোগেও আমের মুকুল-ফুল-গুটি আক্রান্ত হতে পারে। কখনও গাছে এ রোগের আক্রমণ দেখা দিলে ম্যানকোজেট গ্রুপের ছত্রাকনাশক দুই গ্রাম অথবা ইমাডোক্লোরিড গ্রুপের দানাদার প্রতিলিটার পানিতে দশমিক দুইগ্রাম, তরল দশমিক ২৫ মিলিলিটার ও সাইপারম্যাক্সিন গ্রুুপের কীটনাশক প্রতিলিটার পানিতে এক মিলিলিটার মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আবার মুকুল গুটিতে রূপান্তর হলে একই মাত্রায় দ্বিতীয়বার স্প্রে করার জন্য চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।