অপরাধ বিচিত্রা ডেস্কঃ
উপকূলের প্রান্তিকে লেগেছে তথ্যপ্রযুক্তির ছোয়া। শ্রেণী কক্ষে প্রোজেক্টরের মাধ্যমে পাঠদান করছেন শিক্ষক। ক্লাসে উপস্থিত সব শিক্ষার্থীর দৃষ্টি বড় পর্দায়। আগ্রহের সঙ্গে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে তারা শুনছে স্যারের কথা। বইয়ের পাতার লেখা ও ছবিগুলো উঠে এসেছে বড় পর্দায়। শিক্ষার্থীরা সহজেই বুঝে নিচ্ছে পড়ার বিষয়। এই ধরনের পাঠদানে শিক্ষক-ছাত্র উভয়ই শ্রেণীকক্ষে সাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। পাঠন-পাঠনেও এসেছে গতি। এমন চিত্র এখন চোখে পড়ে উপকূলের বহু স্কুলে। বিচ্ছিন্ন জনপদের বহু স্কুলে পড়েছে তথ্যপ্রযুক্তির আলো। তথ্যপ্রযুক্তির ছোয়া বদলে দিয়েছে পাঠদান ও পাঠ গ্রহণের পদ্ধতি। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তি জীবনের নানান দিকে যেভাবে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও নিয়ে এসেছে নতুন মাত্রা। স্কুলে পাঠদান পদ্ধতি আধুনিকায়ন হওয়ায় বাড়িতে পড়া মুখস্থ করার প্রয়োজনীয়তা কমেছে।
দ্বীপ জেলা ভোলা সদর উপজেলার টবগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মনপুরার উত্তর সাকুচিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাজীরহাট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার চর চাপলি ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠদানের দৃশ্য চোখে পড়ে। এটি শিক্ষার্থীদের এগিয়ে দিচ্ছে অনেকখানি। সহায়তা করছে লেখাপড়ায়। ওরা প্রবেশ করছে বর্হিবিশ্বের অবারিত জ্ঞানের জগতে। মোবাইলের স্ক্রীনে অনলাইনে খবর পড়া, নিজের ই-মেইল থেকে দেশে-বিদেশে যোগাযোগ রাখা এসব ওদের কাছে এখন খুবই সহজ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙনসহ বহুমূখী প্রাকৃতিক দুর্যোগে মেঘনা পাড়ের বিপন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরা নিজেরাই নিজেদের জীবনের সমস্যা সমাধানের পথ বের করছে।
জানা যায়, ভোলার মেঘনাতীরের টবগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রযুক্তির আলো শিক্ষার্থীদের ভাবনার জগতে প্রভাব ফেলছে। লেখাপড়ার সঙ্গে ওরা চারপাশের জগতের সঙ্গেও পরিচিত হচ্ছে। বিদ্যালয় ভবনের দোতলায় কম্পিউটার ল্যাবে পাঠদানের সব আয়োজন আছে। তবে বিদ্যুৎ সংকটে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পাঠদান। রয়েছে আরও কিছু সমস্যা। তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণে সংকট দূর করার দাবি বিদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের। বিদ্যালয়ের দোতলায় একটি বড় পরিসরের কক্ষে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্লাস চলে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিলের সভাও হয় এখানে। শিক্ষার্থীরা জানায়, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য তারা জানতে পারছে। এতে পড়ালেখার পাশাপাশি সিলেবাসের বাইরেও জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়তা হচ্ছে। ইন্টারনেট থেকে যেকোন বিষয় সহজেই তারা এখন বের করে জেনে নিতে পারছে। যা এক সময় কল্পনাতীত ছিল তাদের কাছে। শিক্ষার্থীরা আরও জানায়, স্কুলে আমরা একটি কাউন্সিল গঠন করেছি। এতে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এই কাউন্সিলের মাধ্যমে আমরা লন্ডনের স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি। অভিজ্ঞতা বিনিময় করে জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে পারছি। অসীম আচার্য্য জানালেন, বিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাবে নিয়ে ছেলেমেয়েদের ক্লাস নেওয়া হয়। ছেলেমেয়েদের মাঝে এই ক্লাসের বিষয়ে অনেক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। ওরা অন্য ক্লাসে কিছুটা অনাগ্রহ দেখালেও এই ক্লাস ফাঁকি দেয় না। শেখার ইচ্ছা আছে। ইন্টারনেটের জগৎ শিক্ষার্থীদের কাছে টানে। তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ততা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে দিচ্ছে। উপকূলের প্রান্তিকের বেশ কয়েকটি স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। অধিকাংশ স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব আছে, মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করেন শিক্ষকেরা। ফলে পাঠদান পদ্ধতি হয়ে উঠছে প্রাণবন্ত। শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার চেয়ে ক্লাসে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে অতি প্রান্তিকের কিছু স্কুলে বিদ্যুৎ সুবিধার অভাবে এখনও এই সুবিধা পৌঁছেনি।
সূত্র বলছে, চাকরির ক্ষেত্রে ৬ মাস মেয়াদী ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট কোর্সের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় স্কুলের বাইরেও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শেখার আগ্রহ বেড়েছে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে এ সার্টিফিকেট কোর্স করানো হয়। বহু শিক্ষার্থী স্কুলে লেখাপড়াকালীন কম্পিউটার শিক্ষার এই কোর্স সম্পন্ন করছেন। ফলে তাদের সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ বাড়ছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরবাটা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এ সেন্টার থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭০০ ছাত্র সার্টিফিকেট পেয়েছে। আরও প্রায় ৬শ’ ছাত্র কোর্স সম্পন্ন করে সার্টিফিকেট পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এ সেন্টার থেকে কোর্স সম্পন্নকারীদের মধ্যে প্রায় একশজন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। তথ্যপ্রযুক্তি গ্রামীণ পর্যায়ে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এক সময়ে ছেলেমেয়েরা কাগজপত্র নিয়ে ভর্তি পরিক্ষা দিতে যেত। রেজাল্টের জন্য আবার যেতে হতো। এখন সবকিছু হাতের কাছে। পরিক্ষার নোট শিক্ষকেরা ইমেজ আকারে মোবাইলে দিয়ে দেয়।
উপকূলের প্রান্তিকে শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির আলো ছড়াতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হচ্ছে আরও নতুন নতুন পদক্ষেপ। এমন একটি তথ্য পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড থেকে। এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে উপকূলীয় জেলা বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় পরিক্ষামূলকভাবে ১৫৬জন শিক্ষার্থীর হাতে ট্যাব দেওয়া হচ্ছে। এই ট্যাবের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে না। প্রয়োজনীয় সকল কারিকুলামের সফট কপি ট্যাবে দেওয়া থাকবে। ফলে শিক্ষার্থীদের আর বই নিয়ে স্কুলে আসতে হবে না।
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলায় তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে গত কয়েক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। উপজেলার ৩১টি স্কুল-মাদ্রাসার মধ্যে ১৬টিতে নিয়মিত মাল্টিমিডিয়া ক্লাস হচ্ছে। বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সব ব্যবস্থা আছে। যদিও কোথাও ইন্টারনেটের ধীরগতি, কোথাও বিদ্যুৎ সমস্যা ইত্যাদির কারণে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়া নিয়মিত সম্ভব হচ্ছে না। তথ্যপ্রযুক্তি পাঠদানের পদ্ধতিতে যেমন পরিবর্তন এনেছে, শিক্ষার্থীদের পাঠ গ্রহণেও পরিবর্তন এনেছে। কোন একটি বিষয় বইয়ের পাতায় না থাকলেও অনায়াসে তারা ডাউনলোড করে এখন পড়তে পারে।