১৫ বছরের এক কিশোরী। হঠাৎ তার আচার-আচরণে অনেক পরিবর্তন দেখা যায়। মাঝেমধ্যে মুঠোফোনে লুকিয়ে লুকিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলে সে। প্রথমে মা-বাবা তেমন কিছুই মনে করেননি। তাঁরা মনে করতেন, হয়তো বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলছে। তবে কথা বলার পরিমাণ বেড়ে গেলে মা তাকে একদিন ডেকে নিয়ে জেরা করেন। জেরার মুখে সে স্বীকার করে একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। মা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন এখন তার প্রেম করার বয়স নয়। কিন্তু তার কিছু ভালো লাগে না।
পরীক্ষায় খারাপ করায় তাকে শাসন করেন বাবা। বাবার শাসনে বিরক্ত হয়ে অভিমান করে ওই কিশোরী গ্রামের মুদি দোকান থেকে কেরি পোকা মারার ওষুধ কিনে খেয়ে আত্মহত্যা করে। অন্যদিকে বিয়ের প্রথম কয়েক বছর সংসারটা সুখেই কাটছিল এক গৃহবধূর। একসময় তার স্বামী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এতে সংসারে অভাব দেখা দেয়। ফলে শুরু হয় ঝগড়া-অশান্তি। তা ছাড়া স্বামী প্রায়ই শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে বলে তাকে। দু-একবার টাকা এনেও দিয়েছে। এতেও ক্ষান্ত হয়নি মাতাল স্বামী। একসময় স্বামীর নির্যাতন সইতে না পেরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে ওই গৃহবধূ। এমন ঘটনা কুমিল্লার মুরাদনগরের গ্রামগুলোতে অহরহ ঘটছে। সম্প্রতি থানার অপমৃত্যুর রেকর্ড খাতা ঘেঁটে ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দুই বছরে এ উপজেলায় ৬২০ জন আত্মহত্যা করেছে। এদের মধ্যে ৪১৭ জন বিষ খেয়ে, অন্য ২০৩ জন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আবার অনেকেই পরিমাণে কম খাওয়ায় বা তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছে। গত এক মাস উপজেলার ৩৫টি গ্রাম ঘুরে অভিভাবক ও তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন অল্প বয়সে মুঠোফোনের মাধ্যমে ছেলে-মেয়েরা প্রেমের সম্পর্কে জড়াচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকে পরিবারের বাধার মুখে পড়ে আত্মহত্যা করছে। আবার অনেকে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। তবে বড়দের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার সঙ্গে নির্যাতন, নেশা ও পারিবারিক কলহ জড়িত। এদের বেশির ভাগই কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করছে। স্থানীয় মুদি দোকানগুলো থেকে খুব সহজেই কীটনাশক সংগ্রহ করা যাচ্ছে। কিন্তু আইনে আছে, উপজেলা কৃষি অফিসের লাইন্সেস ব্যতীত কেউ কীটনাশক বিক্রি করতে পারবে না। তা ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক ও পরিচিতজন ছাড়া এগুলো বিক্রি করা যাবে না; কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো। পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানগুলোতে ইঁদুর মারার ওষুধ বা পোকা মারার বিষ এখন সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। আর হাতের কাছে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের এই বিষ পেয়ে সাধারণ ঘটনায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অনেকেই। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. আব্দুল মানিক বলেন, বিষ খেয়ে হাসপাতালে প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ চিকিৎসা নিতে আসে। সাধারণত পোকা মারার ওষুধ তৈরি হয় অ্যামোনিয়াম ফসফেট দিয়ে। এটি মানবদেহের পাকস্থলীতে গিয়ে পানি পেয়ে দ্রুত বিষাক্ত ফরজিন গ্যাসে পরিণত হয়, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে মানুষ দ্রুত মারা যায়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল-মামুন রাসেল বলেন, ‘এ উপজেলায় ১৩ জন পাইকারি আর ২১৩ জন খুচরা কীটনাশক বিক্রেতা আছে। প্রত্যেকেই আইন মেনে ব্যবসা করছে কি না সেদিকে আমাদের কঠোর নজরদারি আছে। উপজেলার কৃষকরা শস্য সংরক্ষণের জন্য বাসায় অ্যান্টি রেড (কেরি পোকা মারা ওষুধ) রাখে। তাই পরিবারের সদস্যরা হাতের কাছেই এ ওষুধ পায়। তবে এ ওষুধ ব্যবহার করা না হলে আত্মহত্যার পরিমাণ অনেক কমে আসবে। তাই আমরা এ ওষুধের বিকল্প নিমপাতা বা নিশিন্দাপাতার গুঁড়া ব্যবহার করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি।’ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম খসরু বলেন, ‘অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ, দুর্বল মনমানসিকতা, আর্থিক সংকটসহ অভিভাবকদের উদাসীনতার জন্য আত্মহত্যাজনিত ঘটনা বেশি ঘটছে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের এখন থেকেই সচেতন হতে হবে। কারণ, সচেতনতাই পারে আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে।’