নিষিদ্ধ যানবাহন থেকে ‘বিশুদ্ধ’ আয় করছে দোহাজারী হাইওয়ে থানা পুলিশ। মহাসড়কে অটোরিকশা, ট্রলিসহ তিন চাকার যানবাহনকে চলাচলের সুযোগ দিয়ে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা আয় হচ্ছে।
এছাড়া সড়কে বৈধ কোনো কাগজপত্র ছাড়াই শুধু হাইওয়ে পুলিশের টোকেন নিয়ে মালপত্র ও যাত্রীবাহী পিকআপ, ট্রাক নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও লাইসেন্সবিহীন চালকরা। লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা এসব যানবাহন নিয়ে যত্রতত্র চলে যাত্রী ও মালামাল উঠানামা। ফলে দুর্ঘটনার পাশাপাশি সড়কে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। টোকেনের নামে দেওয়া স্টিকার গাড়ির কাচে সাঁটানো থাকলে গাড়িগুলো চলাচল করতে কোনো সমস্যা হয় না। অন্যথায় চলে নানা হয়রানি। যানবাহন থেকে চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে ইতোপূর্বে হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এদিকে উত্তর সাতকানিয়া জাফর আহমদ চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ গেট এলাকা দোহাজারী হাইওয়ে পুলিশের ‘স্থায়ী’ ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। দিনে হোক বা রাতে কলেজের সামনে দেখা মিলবেই তাদের। সেখানে দাঁড়িয়ে যানবাহনের কাগজপত্র দেখার নামে চলে চাঁদাবাজি। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের মুজাফ্ফরাবাদ থেকে লোহাগাড়ার চুনতি পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার সড়ক দোহাজারী হাইওয়ে থানার আওতাধীন। কিন্তু তারা দিন রাত অবস্থান করে শুধু জাফর আহমদ চৌধুরী কলেজের সামনে। ফলে পুরো সড়ক থাকে অরক্ষিত। সংশ্লিষ্টরা জানান, মহাসড়কে নিরাপত্তা জোরদার, যানবাহন দুর্ঘটনা, সড়ক পথে মাদকপাচার ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ, সড়ক অপরাধ প্রতিরোধ এবং সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ হাইওয়ে পুলিশের মূল কাজ। কিন্তু দোহাজারী হাইওয়ে পুলিশ আসল কাজ বাদ দিয়ে নানা ফাঁদ পেতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ে বেশি ব্যস্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। সাতকানিয়ার করাইয়ানগর এলাকার অটোরিকশাচালক আলী হোসেন বলেন, ‘সরকার মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ করার পর আমরাও কিছুদিন বন্ধ রেখেছিলাম। কিন্তু এখন হাইওয়ে পুলিশকে মাসিক হারে টাকা দিয়ে চালাচ্ছি। প্রতি মাসে চাহিদামতো টাকা দিলে মহাসড়কে চলাচল করতে কোনো সমস্যা হয় না। সড়ক দিয়ে মাঝে মধ্যে মন্ত্রী এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা গেলে হাইওয়ে পুলিশ আমাদেরকে আগাম সতর্ক করে দেয়। তখন মহাসড়কে গাড়ি চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখি।’ সাতকানিয়ার ছদাহা এলাকার ট্রলিচালক নুরুল আমিন বলেন, ‘হাইওয়ে পুলিশ আমাদেরকে কিছুদিন মহাসড়কে চলাচল করতে দেয়নি। কিন্তু মহাসড়কে উঠতে না পারলে আমরা ভাড়া পাই না। ফলে হাইওয়ে পুলিশকে মাসিক ৩০০ টাকা করে দিয়ে গাড়ি চালাই।’ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের বাসচালক সাতকানিয়ার মো. সাহাব মিয়া বলেন, ‘সড়কে ট্রলি চলতে দেখলে আমরা নিজেরা ভয়ে থাকি। ব্রেক ও হর্নবিহীন এসব ট্রলি চলে বেপরোয়া গতিতে। ৬-৭ ফুট বডির ট্রলিগুলোতে ৩০-৪০ ফুট লম্বা গাছও বহন করা হয়। এসব গাছ বাঁক পার হওয়ার সময় সহজে অন্য গাড়ির সঙ্গে লেগে যায়। ফলে ট্রলির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। আর পুলিশ বৈধ গাড়িগুলোকে নানাভাবে হয়রানি করে। টাকার বিনিময়ে এসব অবৈধ যান চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়।’সাতকানিয়ার কেরানীহাট এলাকার মিনি ট্রাক মালিক নুরুল কবির ও মো. মহিউদ্দিন বলেন, হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজিতে আমরা অতিষ্ঠ। গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকা সত্ত্বেও মাসিক টোকেন নিতে হয়। টোকেন না নিলে অহেতুক হয়রানি করে। তাঁরা জানান, জাফর আহমদ চৌধুরী কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির কাগজপত্র চেক করার নামে ‘বিশুদ্ধ’ আয় করা হাইওয়ে পুলিশের নিত্যকাজে পরিণত হয়েছে। সড়কের চন্দনাইশের দোহাজারী, সাতকানিয়ার কেরানীহাট ও লোহাগাড়ার বটতল স্টেশনে নিত্য যানজট থাকলেও হাইওয়ে পুলিশকে কখনো সেখানে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না। নাজিম উদ্দিন নামের এক ট্রাকচালক জানান, গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকলে টোকেনের দাম দেড় হাজার টাকা, আর না থাকলে দুই হাজার টাকা। সেই বিবেচনায় কাগজ না থাকাটাই ভালো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পরিবহন শ্রমিক নেতা জানান, দোহাজারী হাইওয়ে থানায় সরকারি কোনো রেকার নেই। ওসির মনোনীত ফজল করিম নামে এক লোকের দুটি রেকার সব সময় থানায় থাকে। মাসিক টোকেন না নিলে অনেক সময় গাড়ি পার্কিংয়ে থাকা অবস্থায় পুলিশ গিয়ে রেকার দিয়ে থানায় নিয়ে যায়। তখন গাড়ি ছাড়িয়ে আনতে গেলে টোকেনের টাকার পাশাপাশি রেকার ভাড়া বাবদ মোটা অংকের টাকা দিতে হয়। আর রেকার ভাড়ার অর্ধেক টাকা পায় পুলিশ। সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকার ট্রাকমালিক মোহাম্মদ শাহআলম রেকার ভাড়া নিয়ে হাইওয়ে পুলিশ ব্যবসা করছে বলে অভিযোগ করেন। দোহাজারী হাইওয়ে থানার ওসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল করে না। কাগজপত্রবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দেওয়া হচ্ছে। আর হাইওয়ে পুলিশ টোকেন দেয় না। কোনো গাড়ি থেকে মাসিক হারে চাঁদা আদায়ও করে না।’ সারাক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মিডল পয়েন্ট হিসেবে জাফর আহমদ চৌধুরী কলেজের সামনে অবস্থান করি। প্রয়োজন হলে সেখান থেকে অন্য দিকেও যাই।’ অপ্রয়োজনে রেকার ব্যবহার এবং গলাকাটা ভাড়া আদায়ের বিষয়ে তিনি জানান, থানায় সরকারিভাবে রেকার না থাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন রেকার ব্যবহার করা হয়। রেকার ভাড়া থেকে পুলিশ কোনো কমিশন নেয় না।