শেকরের টানে বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের নারী রওফি

0
632

মা-বাবার খোঁজে আসা সুইজারল্যান্ডের নারী রওফির মায়ের দাবিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন কুড়িগ্রামের রফিতন বেওয়া (৬৫)। ঘটনার অনেক অমিল থাকলেও তার দাবি প্রায় ২৮/৩০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া তার নাড়িছেঁড়া ধন শাহেরাই বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের রওফি।

 

তবে রওফির দাবি প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে হারিয়ে যাওয়ার সময় তার নাম ছিল খোদেজা। সে হারিয়ে যাওয়ার পর চিলমারী ছিন্নমুকুলে (বেসরকারি সাহায্য সংস্থা) তার আশ্রয় মেলে। এখানে চার বছর থাকবার পর ১৯৭৮ সালের দিকে সুইজারল্যান্ডের এক দম্পতি তাকে দত্তক নিয়ে চলে যায়। এরপর থেকে দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে বেড়ে ওঠেন রওফি ওরফে খোদেজা। সম্প্রতি নাড়ির টানে জন্মভূমি বাংলাদেশে এসেছিলেন হারিয়ে যাওয়া বাবা-মা বা বংশধরদের খোঁজে। সপ্তাহখানেক বিভিন্ন জায়গায় চষে বেড়িয়ে দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে শূন্যহাতে ফিরে যান সুইজারল্যান্ডে বর্তমানে পালিত বাবা-মায়ের কাছে। তার ফিরে যাওয়ার তিনদিন পর শুক্রবার সকালে মায়ের দাবিতে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন চত্বরে খুঁজে ফিরছেন সন্তান হারানো মা রফিতন। রওফি ওরফে খোতেজাকে নিজের সন্তান বলে দাবি করছেন তিনি। এজন্য তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সহায়তা চান সাংবাদিকদের কাছে। মায়ের দাবিদার রফিতন বেওয়া জানান, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের অর্জুন গ্রামের বাসিন্দা তিনি। তার স্বামীর নাম ছাত্তার আলী। ২২ বছর পূর্বে স্বামী মারা যান। স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন তিনি। তার সংসারে দুটি মেয়ে এবং একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। বড় সন্তান শাহেরা ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় হারিয়ে যায়। তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘ঘরোত খাবার নাই। চারপাকোত মঙ্গা। খাবার দিবের পাং না। ছওয়াটা মোড় হারি গেইল।’ সেসময় ৭/৮ বছরের বড় মেয়ে খাবারের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে হারিয়ে যায়। এরপর অনেক খুঁজেও তাকে আর পাওয়া যায়নি। সুজারল্যান্ডের অধিবাসী রওফি থেথরাইয়ে আসার সময় তিনি ছোট মেয়ের বাড়িতে অবস্থান করায় তার সঙ্গে দেখা হয়নি। পরে ফেসবুকে ঘটনা জানাজানি হলে প্রতিবেশীরা তাকে খবর দেন। শুক্রবার সকালে অনেক আশা নিয়ে ছেলে রফিকুলসহ তিনি কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আসেন। সেখানে তখন সুনসান নীরবতা। বড়বড় তালা ঝুলছে অফিসগুলোতে। চারদিকে ফ্যালফ্যাল চোখে লোকজন খুঁজছিলেন তিনি। কাকে কি বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। পরে বিষয়টি সাংবাদিকদের নজরে এলে তিনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘মোর বেটি কই? এক নজর তাক মুই দেখিম। তোমরা একনা ব্যবস্থা করি দেও।’বর্তমানে থেথরাই বাজারে ঝালবুটের দোকানদার রফিতন বেওয়ার পুত্র রফিকুল জানান, হারিয়ে যাওয়া শাহেরা ছিল সবার বড় বোন। সে কয়েক মাস স্কুলেও পড়েছিল। তার বাবা ছাত্তার আলী ছিলেন ধবধবে ফর্সা লোক। তার মাও ফর্সা। তারা প্রথমে দলদলিয়ার অর্জুন গ্রামে থাকলেও তিস্তার ভয়াবহ ভাঙনে সেই বাড়ি বিলীন হয়ে যায়। এর ছয় বছর পরে (২০১৩ সালে) তারা থেথরাই শেখের খামার গ্রামে ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেন। এখন মাকে নিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন তারা।রফিতন বেওয়া ও পুত্র রফিকুলের কথার সঙ্গে সুজারল্যান্ডের অধিবাসী রওফির কথার অনেক অমিল পাওয়া যায়। রওফি শ্যামবর্ণের হলেও রফিতন ও তার স্বামী ছিলেন অনেক ফর্সা। রওফি সাড়ে ৩ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়ার কথা বললেও রফিতন বেওয়ার মেয়ে শাহেরা হারিয়ে যায় ৭-৮ বছর বয়সে। দু’জনের নামের মধ্যেও রয়েছে গরমিল। এছাড়াও ১৯৭৪ সালে তারা ছিলেন পার্শ্ববর্তী দলদলিয়া ইউনিয়নের অর্জুন গ্রামে। দু’পক্ষের বর্ণনার মধ্যে যথেষ্ট ফারাক থাকলেও এক হারিয়ে যাওয়া কন্যার আকুতি আর মেয়ের জন্য মায়ের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানো এলাকায় এখন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ ব্যাপারে থেথরাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল জলিল শেখ জানান, আমরা এলাকাবাসী রফিতনের হারিয়ে যাওয়া মেয়ের ঘটনার কথা সবাই জানি। এর আগেও চট্টগ্রামে হারিয়ে যাওয়া মেয়ের খোঁজে গিয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে সুজারল্যান্ডের অধিবাসী রওফির সঙ্গে রফিতনের মেয়ের অনেক মিল পাওয়া যায়। বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজনে উভয়ের ডিএনএ টেস্ট করে দেখা দরকার। তাহলে বিধবা রফিতন মনে একটু শান্তি পাবেন।

রওফি’র বক্তব্য ও ঘটনার আদ্যোপান্ত

কুড়িগ্রামের উলিপুর ও চিলমারীতে হারানো বাবা-মায়ের খোঁজে হন্যে হয়ে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক সুইজারল্যান্ডবাসী কন্যা। স্বামী ও প্রবাসী বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান করেও কোনো সূত্র না পেয়ে হতাশ পরিবারটি। তারপরও মনের কোণে আশা হয়তো ফিরে পাবেন হারানো বাবা-মাকে। পরিবারটির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের অতীত ইতিহাস। মেয়েটি জানান, দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তিনি। বিদেশ-বিভুঁইয়ে মানুষ হয়েছেন দত্তক সন্তান হিসেবে। কোনো কিছুর ঘাটতি রাখেননি সেই বাবা-মা। তারপরও কোথায় যেন একটু রক্তক্ষরণ! চিনচিনে ব্যথা মনে দাগ বসিয়ে দিয়েছিল। সংসার-স্বামী-সন্তানকে নিয়ে সুখে থাকলেও একটা বিনা সুতোর টান অনুভব করতেন মনের খাঁচায়। বড় হয়ে যখন জানলেন তার দেশ সুইজারল্যান্ড নয়। জন্ম বাংলাদেশে। তখন থেকেই খচখচ করছিল মনটা। এক সময় স্বামীকে বলেই ফেললেন আরাধ্য কথাটি। স্বামীও রাজি হলেন তার কথায়। তারপর বাংলাদেশে খুঁজতে এলেন হারিয়ে যাওয়া বাবা-মাকে। এই হলো পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত সুইজারল্যান্ডের নাগরিক রওফি ওরফে খোদেজার জীবন কাহিনী। প্রবাসী খোদেজা এখন চষে বেড়াচ্ছেন কুড়িগ্রামের উলিপুর ও চিলমারী উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জ। তার সফরসঙ্গী ও অন্যান্য লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে সাড়ে ৩ বছর বয়সী খোদেজাকে উলিপুর উপজেলার থেতরাই বাজারে কাঁদতে দেখে পার্শ্ববর্তী চিলমারী উপজেলায় অবস্থিত বেসরকারি শিশু সংগঠন টেরেডেস হোমস-এর একটি নোঙ্গরখানায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ছিল সে। এরপর সুইজারল্যান্ডের রওফি পরিবার তাকে দত্তক নেয়। ছোট্ট বেলার স্মৃতি একটি সাদাকালো ছবি নিয়ে সে নতুন বাবা-মায়ের সাথে পাড়ি দেয় জেনেভা শহরে। সেখানেই সন্তান হিসেবে পরিচতি লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করে জেনেভার সাইকেল ডেলা গোলেহে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে ২০০১ সাল থেকে কাজ করছেন। মা-বাবা হারানোর সময়ের স্মৃতি হিসেবে তার কোনো কিছু মনে নেই। তবে তিনি জানান এতটুকু মনে রয়েছে আমি তখন অন্য কোনো শহরে চলে এসেছি। এতদিন পরে আমি আমার নিজের জন্মভূমিতে এসেছি শুধুমাত্র আমার প্রকৃত মা-বাবার খোঁজে। কিন্তু আমি তাদের নাম-ঠিকানা কিছু্‌ই জানি না। আছে শুধু আমার নিজের একটি ছোটবেলার সাদাকালো ছবি। শেষ বয়সে এসে যদি আমার মা-বাবা এবং বংশধরদের খুঁজে পাই। জানি না পাবো কিনা। তবে পেলে আমার থেকে বড় খুশি আর কেউ হবে না। খোদেজা সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় পড়াশোনা শেষ করে সেখানকার এক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার জিইয়াস মরিনোকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে ৫ বছরের ইলিয়াস নামের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। খোদেজার সফর সঙ্গী হিসেবে ইনফ্যান্টস ডু মনডে’র কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর রাকিব আহসান জানান, প্রাথমিকভাবে আমাদের সোর্সদের কাজে লাগিয়ে আমরা খোদেজার মা-বাবা এমনকি তার স্বজনদের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু কেউ কোনো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেনি। তবে কেউ যদি কখনো খোদেজার মা-বাবার পরিচয় দাবি করেন সে বিষয়ে আমরা সঠিক তথ্য-উপাত্তসহ ডিএনএ টেস্ট করিয়ে শতভাগ নিশ্চিত হব। কেননা আমরা চাই না এই সময় এসে খোদেজা কোনো প্রতারণার শিকার হোক। অপর সফর সঙ্গী জেনেভা বাংলা পাঠশালার পরিচালক ও সুইস বাংলাদেশ কালচারাল এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক বলেন, খোদেজার সঙ্গে আমার পাঠশালাতেই পরিচয় হয়। সেখানে আলাপচারিতার তার শৈশবের কথা জানালে আমিও তার মা-বাবার খোঁজে এসেছি। কিন্তু বিষয়টি খুবই জটিল। কেননা কোন ডকুমেন্টস আমাদের হাতে নেই। কিন্তু তারপরেও যদি মিরাকল কিছু ঘটে। স্থানীয় এনজিও কর্মী নুরুল হাবীব পাভেল জানান, সেই সময় কুড়িগ্রামে খুবই দুর্ভিক্ষ ছিল। তখনকার পরিস্থিতি দেখে চিলামারীর নুরন্নবী চৌধুরী, দেলোয়ার মাস্টার, ছমচ হাজীসহ অনেকেই একটি নোঙ্গর খানা খোলেন। পরবর্তীতে টিডিএইচ নোঙ্গরখানাটি নেন। সেখানে ১২শ’ শিশু ছিল নোঙ্গরখানায়। প্রতি ৫০ জন শিশুকে দেখার জন্য একজন করে টিম লিডার ছিল। খোদেজার টিম লিডার আনিছুর ছিলেন। সে খোদেজার ছবি দেখে চিনতে পেরেছে। কিন্তু তার মা-বাবার বিষয়ে কিছুই বলতে পারেনি। তিনি আরো জানান, ১৯৭৮ সালে আমার জানা মতে ৩৬ জন এতিম শিশুকে অনেক বিদেশি দত্তক নিয়েছিল। খোদেজার সঙ্গে তার সমবয়সী পিপিজ এবং কুরানী নামের আরো দুটি শিশু বিদেশে গিয়েছিল। সেই সময় টিডিএইচ-এ যেসব শিশু বড় হয়েছিল তাদের মধ্যে যাদের মাতা-পিতা মারা গেছে তাদেরকে শুধু বিদেশে দত্তক দিয়েছে। আর যাদের পিতা মাতা ছিল তাদের স্বাবলম্বী করে দেয়া হয়। আর খোদেজাকে রাস্তা থেকে নিয়ে আসায় তার পিতা-মাতা সম্পর্কে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারছে না।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

11 − 7 =