অবৈধ সম্পদ অর্জনে আবজালের কারিশমা আলাদিনের দৈত্যকেও হার মানিয়েছে

0
636

মো: আহসানউল্লাহ হাসানঃ মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাড ও যুক্তরাষ্ট্র সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অঢেল সম্পদ, রয়েছে স্ত্রীর নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বছরে ২০-২৫ বার বিজনেস ক্লাসে করেন বিদেশ ভ্রমণ। বাম হাতে পড়েন রোলেক্স ব্রান্ডের ঘড়ি, আগুলে হিরার আংটি। উত্তরার এক সড়কেই পাঁচটি বাড়ি। গুলশান, বনানী, বারিধারায় ২০টি, সারাদেশে প্লট-বাড়ি কেনায় সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। দেশে-বিদেশে তার মোট সম্পদকে টাকায় হিসাব করতে হিমশিম খাচ্ছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা। তবে ২৪ বছরের চাকরি জীবনে ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো সম্পদের মালিক তিনি। শুধু আবজাল নিজেই নয়, তার চৌদ্দগোষ্ঠীর মধ্যে তেরগোষ্টীই কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। সবই হয়েছে আবজালের হাতের জাদুতে। এটা রীতিমতো আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্যকেও হার মানিয়েছে। সব মিলিয়ে আবজাল ও তার স্ত্রী রুবিনা এখন ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক বলে ধারনা করা হচ্ছে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. আবজাল হোসেন। অধিদফতরের সিনিয়রদের যোগসাজশে কেনাকাটার টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। বদলি বাণিজ্যও করতেন। তবে দুর্নীতি আর অবৈধ আয়ে সিনিয়রদেরও টপকে গেছেন আবজাল। আবজাল হোসেন ১৯৯৩ সালে ১২০০ টাকার স্কেলে চাকরি নেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের উন্নয়ন প্রকল্পে। ১৯৯৫ সালে দিনাজপুর, বগুড়া, খুলনা, ফরিদপুর ও কুমিল্লাসহ পাঁচটি মেডিকেল কলেজ প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারীর দফতরে ক্যাশিয়ার হিসেবে অস্থায়ী ভিত্তিতে সরকারি চাকরি জীবন শুরু করেন। চাকরির কয়েকদিন পরই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের ক্যাশিয়ার পদে অধিভুক্ত হন। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে প্রেষণে এক যুগের বেশি সময় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখায় নিয়োজিত ছিলেন। ২০০০ সালের প্রকল্পটির রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হয়। চাকরির একসময় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে বদলি হয়ে একই ধারাবাহিকতায় প্রেষণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখায় কমরত থাকেন। এরপর অধিদফতরের অন্যান্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বদলি হয়ে আসেন মহাখালীতে।
আবজালের স্ত্রী মোসাম্মৎ রুবিনা খানম ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে স্টেনোগ্রাফার পদে চাকরি শুরু করেন। ২০০৯ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। তবে গৃহিণী হওয়ার জন্য নয় বরং ব্যবসার জন্য অব্যাহতি নিয়েছিলেন। ২০০৫ সালে ‘রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানের ‘মালিক’ছিলেন রুবিনা খানম।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কয়েকজনের মদদে ‘রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার নামে টাকা নিয়ে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহে বরাদ্দ হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে ‘বইপত্র সাময়িকী’ ছাপানোর ভুয়া টেন্ডার দেখিয়ে দুই বিলপত্রে ৬ কোটি টাকার বিল ছাড় করিয়ে নেয়। এ ছাড়াও একই মেডিকেল কলেজের ‘যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম ক্রয়’ এর জন্য ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৮৮ হাজার ৮০০ টাকার বিল পাস করিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এসব অনিয়মের প্রমাণও পেয়েছে দুদক।
এ ছাড়াও তাদের ১০ কোটি ৯৯ লাখ ৮৮ হাজার ৮০০ টাকার তিনটি বিলে ছাড়পত্র দানকারী স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা ও শিক্ষাস্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক এবং লাইড ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুর রশিদকেও জড়িত সন্দেহ করা হচ্ছে। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। আবজালের জ্ঞাত সম্পত্তিকে টাকায় অঙ্কে আনতে হিমশিম খাচ্ছে দুদকের কর্মকর্তারা। তবে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কেই তাদের ৪টি পাঁচতলা বাড়ি ও একটি প্লট রয়েছে। ১১ নম্বর সড়কের ১৬, ৪৭, ৬২ ও ৬৬ নম্বর বাড়িটি তাদের নামে। সড়কের ৪৯ নম্বর প্লটটিও তাদের।
মিরপুর পল্লবীর কালশীর ডি-ব্লকে ৬ শতাংশ জমির একটি, মেরুল বাড্ডায় আছে একটি জমির প্লট। মানিকদি এলাকায় জমি কিনে বাড়ি করেছেন, ঢাকার দক্ষিণখানে আছে ১২ শতাংশ জায়গায় দোতলা বাড়ি।

নিজ জেলা ফরিদপুর শহরে টেপাখোলা লেকপাড়ে ফরিদের স’মিলের পাশে নিজে কিনেছেন ১২ একর ৮০ শতাংশ জমি। ওই জমির প্রায় পাশাপাশি টেপাখোলা সুুইস গেটের পাশে ওই এলাকার কমিশনার জলিল শেখের আবাসন প্রকল্পে ৬ শতাংশ করে নিজে প্লট কিনেছেন দুটি। ফরিদপুরে ওইসব ভূ-সম্পদ ছাড়াও শহরের গোপালপুর এলাকার বনলতা সিনেমা হলের পাশে মাস্টার কলোনিতে ১৫ শতাংশ জায়গায় একটি একতলা বাড়ি ও ভাড়ায় চালিত ৩০টি সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক তিনি।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় আবজালের বাবা-মা, ভাই-বোন ও নিকট আত্মীয়দের নামে ২০টিসহ সারাদেশে তাদের প্রায় শতাধিক প্লট ও বাড়ি রয়েছে।
মালয়েশিয়ায় ২ একর জমি (২শ কোটি), অস্ট্রেলিয়ায় ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা-বাড়ি, কানাডায় কেসিনোর মালিকানা-ফার্ম হাউজ এবং যুক্তরাষ্ট্রে হোটেল রয়েছে। অ্যাকাউন্টস অফিসার থাকা অবস্থায় ব্যবহার করেছেন লেক্সাস গাড়ি। যা বাংলাদেশের মন্ত্রী ও সচিব পদের কর্মকর্তারা ব্যবহার করেন। আবজাল দম্পতি নানা কাজের জন্য বছরে ২০ থেকে ২৫ বার দেশের বাইরে ভ্রমণ করেন বিজনেস ক্লাসের টিকেটে।
প্রাথমিক তদন্তে আবজালের উত্তরার বাড়ি-প্লট, ফরিদপুরের অঢেল সম্পদ ও অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি থাকার অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এগুলো টাকার অঙ্কে কত? এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এভাবে যোগ বিয়োগ করা হয়নি। তবে ১৫ হাজার কোটি টাকার কম হবে না।’
আবজাল চাকরিরত অবস্থায় এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পর্দার আড়ালে ছিলেন তার স্ত্রী রুবিনা। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের তদন্তকারী অফিসারদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ২০১২ সালের তৈরি করেছেন পাসপোর্ট যার অধিকাংশ তথ্যই ছিল ভুল (পাসপোর্ট নম্বর এসি-৭৮৯৭২৫৪)। পাসপোর্টে তার বর্তমান, স্থায়ী ঠিকানার জায়গায় তিনি ১৫/১ আলবদিরটেক, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, পল্লবী, ঢাকার ঠিকানা ব্যবহার করেছে। ঠিকানাটি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। রুবিনার বর্তমান ঠিকানা খিলক্ষেতের নিকুঞ্জে এবং স্থায়ী ঠিকানা গোপালগঞ্জে। এমনকি ইমার্জেন্সি কন্টাক্টে তার স্বামী আবজাল হোসেনের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানাকে স্বামীর একই ঠিকানা ব্যবহার করেছেন তিনি।
আবজাল দম্পতির এমন কর্মকান্ডের প্রমাণ পেয়ে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ৮ জানুয়ারি পুলিশের ইমিশেন শাখায় চিঠি পাঠায় দুদক। ১০ জানুয়ারি তাকে দুদক কার্যালয়ে ডেকে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন দুদকের উপ-পরিচালক (ডিডি) সামছুল আলম। আবজালকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তদন্ত কর্মকর্তা সামছুল আলম বলেন, ‘ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি জেলায় জমিজমায় তার মালিকানা মোটামুটি নিশ্চিত। দেশের বাইরে শুধু অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি ও ব্যবসা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। অন্যান্যগুলো যাচাই করা হচ্ছে।’
জিজ্ঞাসাবাদে আবজাল দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন কিনা-জানতে চাইলে বলেন, ‘তিনি কিছু তথ্য দিয়েছেন। তদন্তের স্বার্থে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না।’ জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কয়েকটি সম্পদকে পৈত্রিক বলে দাবি করেছেন আবজাল। যদিও সেগুলোর স্বপক্ষে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি তিনি। এদিকে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ১৪ জানুয়ারি আবজালকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
আবজালের ‘সহযোগী’হিসেবে কাজ করার অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর ড. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, লাইন ডিরেক্টর (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি) অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুর রশিদ ও সহকারী পরিচালক ডা. আনিছুর রহমানকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। আবজালসহ এ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর একটি মামলা করবে দুদক।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seventeen − 1 =