অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা কুয়াকাটা, যার রূপের নাই শেষ

0
1327

কামরুল হাসান রুবেলঃ কলাপাড়া ও খেপুপাড়া বাংলাদেশের পটুয়াখালি জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা।অনেকেই একে খেপুপাড়া নাম ও চেনেন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা এই উপজেলায় অবস্থিত। জেলা শহর থেকে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত প্রায় ৭০ কিলোমিটার।  কুয়াকাটা ছোট্ট একটি গ্রামের নাম। ছোট্ট গ্রামটি আজ আর ছোট নেই। বলা বাহুল্য কুয়াকাটার নাম আজ দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। কুয়াকাটার প্রাকৃতিক  সৌন্দর্য, সাগরের নীল ঢেউ, আদিগন্ত বালুকারাশি, সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মতো অভাবনীয় দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ এই গ্রামটিকে বিশেষভাবে পরিচিত করেছে।  আর এ কারণেই কুয়াকাটা এখন পর্যটন নগরী হিসেবে ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
কুয়াকাটার আরেক নাম ‘সাগরকন্যা’। সমুদ্রের মতো বিশাল এখানকার মানুষের মন। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গেই যেন তাদের আমৃত্যু বসবাস। তাদের জীবন এবং জীবিকাও এই সমুদ্রের ওপরই নির্ভরশীল।

এই উপকূলীয় এলাকার মানুষ কাগজে-কলমে কৃষিনির্ভর হলেও সাগরের মৎস্য আহরণই এখানকার অনত্যম পেশা। ১৯৯৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কুয়াকাটাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর পর্যটন নগরী হিসেবে কুয়াকাটার আত্মপ্রকাশ ঘটে। যদিও এই  সমুদ্র সৈকতটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের  তীর্থ স্থান হিসেবে বহু পূর্ব থেকেই ব্যবহার করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় কুয়াকাটা আজ পর্যটন কেন্দ্র। ১৭৮৪ সালে এ অঞ্চলে  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রাখাইনদের আগমনের ফলে এলাকায় প্রথম মানুষের বসবাস শুরু হয়। তৎকালীন বাখেরগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ বিভারেজের অনুসন্ধানী জরিপ মতে অঞ্জু মংয়ের  নেতৃত্বে তাদের আগমন ঘটে। পরবর্তীতে থুঙ্গারী ও হাঙ্গারী মং দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে বন জঙ্গল কেটে রাখাইন সম্প্রদায় আবাস ভূমি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়।  এলাকায় মিষ্টি পানির সংকট পূরণে রাখাইনরা  বালুমাটি খুড়ে ছোট ছোট কূপ খনন করে পানি সংগ্রহ করতো। সেই কুয়া খনন থেকে আজকের ‘কুয়াকাটা’ নামকরণ করা হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যদিও প্রবীণ জয়নাল খাঁ (৯৭) যিনি এক সময় ব্রিটিশ সেনা সদস্য ছিলেন, তিনি দাবি করেন, এখানকার প্রথম আদিবাসী পাড়া-প্রধান কুয়াসা মংয়ের নামে ‘কুয়াকাটা’ নামকরণ করা হয়েছে। যাই হোক, কবে কখন কুয়াকাটা নামকরণ করা হয়েছে তা আজও সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি। লতাচাপলী, ধূলাশার, খাপড়াভাঙ্গা এই তিন ইউনিয়ন নিয়ে কুয়াকাটা। আয়তনে খুব বেশি বড় না হলেও এখানে আবাদি ও অনাবাদি জমির পরিমান ৩৮,০৬৫ একর। জনসংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। কুয়াকাটা সমুদ্র উপকূলবেষ্টিত অনুন্নত এলাকা হলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়েছে। এখানে শিক্ষার হার ৫৫ শতাংশ।  ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষি ও মৎসজীবি। এই অঞ্চলের মানুষ খেলাধুলা, সংগীত চর্চা আঞ্চিলকতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে করে আসছে বহু কাল আগে থেকে। নৃ-গোষ্ঠী মানুষের চলন, পোষাক-পরিচ্ছদ, ঘর-বাড়িতে রয়েছে ভিন্নতা। এরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ভাষাগত ও জাতিগতভাবে তারা আরাকানি। এ অঞ্চলে রাখাইনরা বছরের বেশির ভাগ সময়ই নানা উৎসবে মেতে থাকতে পছন্দ করে। এদের প্রধান উৎসব ফানুস  ওড়ানো, জলকেলি, পিঠা উৎসবসহ ধর্মযাজক বা নামিদামী ব্যক্তির অন্তষ্টিক্রিয়া।
কুয়াকাটাকে সরকারিভাবে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার পর এখানে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন অর্ধশতাধিক হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। সৈকত পরিবেষ্টিত ১৩৯৮৪ একর বনভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ইকোপার্ক বা ইকো ট্যুরিজম স্পট।
কুয়াকাটার উজ্জ্বল সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের দৃষ্টি না থাকায় জায়গাটি আধুনিক পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে। কক্সবাজারসহ দেশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্র আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিলেও সাগরকন্যাখ্যাত কুয়াকাটার আধুনিকীকরণে সরকার ধীর গতি অবলম্বন করায় এখানে বেসরকারি উদ্যোগও কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
অথচ কুয়াকাটা যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। সরকার একটু উদ্যোগী হলে এখান থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন।সমুদ্র সৈকতকুয়াকাটার বেলাভূমি বেশ পরিচ্ছন্ন। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এ সৈকত থেকেই কেবল সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করা যায়। সৈকতের পূর্ব প্রান্তে গঙ্গামতির বাঁক থেকে সূর্যোদয় সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যায়। আর সূর্যাস্ত দেখার উত্তম জায়গা হল কুয়াকাটার পশ্চিম সৈকত।কুয়াকাটার সৈকত প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। সৈকত লাগোয়া পুরো জায়গাতেই আছে দীর্ঘ নারিকেল গাছের সারি। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে এ বনেও। বিভিন্ন সময়ে সমুদ্রের জোয়ারের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় ভাঙনের কবলে পড়েছে সুন্দর এই নারিকেল বাগান। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে সারা বছরই দেখা মিলবে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য।শুঁটকি পল্লীকুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম প্রান্তে আছে জেলে পল্লী। এখানে প্রচুর জেলেদের বসবাস। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এখানে চলে মূলত শুঁটকি তৈরির কাজ। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এনে সৈকতেই শুঁটকি তৈরি করেন জেলেরা। কম দামে ভালো মানের শুঁটকিও কিনতে পাওয়া যায় এখানে।গঙ্গামতির জঙ্গলকুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত শেষ হয়েছে পূর্ব দিকে গঙ্গামতির খালে। এখান থেকেই শুরু হয়েছে গঙ্গামতির জঙ্গল। অনেকে একে গজমতির জঙ্গলও বলে থাকেন। নানান রকম বৃক্ষরাজি ছাড়াও এ জঙ্গলে আছে বিভিন্ন রকম পাখি, বন মোরগ-মুরগি, বানর ইত্যাদি।ক্রাব আইল্যান্ডকুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পূবদিকে গঙ্গামতির জঙ্গল ছাড়িয়ে আরও সামনে গেল আছে ক্রাব আইল্যান্ড বা কাঁকড়ার দ্বীপ। এ জায়গায় আছে লাল কাঁকড়ার বসবাস। নির্জনতা পেলে এ জায়গার সৈকত লাল করে বেড়ায় কাঁকড়ার দল। ভ্রমণ মৌসুমে (অক্টোবর-মার্চ) কুয়াকাট সমুদ্র সৈকত থেকে স্পিড বোটে যাওয়া যায় ক্রাব আইল্যান্ডে।ফাতরার বনকুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম পাশে নদী পার হলেই সুন্দরবনের শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল, নাম তার ফাতরার বন। সুন্দরবনের সব বেশিষ্ট এ বনে থাকলেও নেই তেমন কোন হিংস্র প্রাণী। বন মোরগ, বানর আর নানান পাখি আছে এ বনে। কদাচিৎ এ বনে বুনো শুকরের দেখা মেলে। কুয়াকাটা থেকে ফাতরার বনে যেতে হবে ইঞ্জিন নৌকায়।কুয়াকাটার কুয়াকুয়াকাটা নামকরণের ইতিহাসের পেছনে যে কুয়া সেটি এখনও টিকে আছে। তবে কয়েক বছর আগে অদূরদর্শী ও কুরুচিকর সংস্কারের ফলে এর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের কাছে রাখাইনদের বাসস্থল কেরাণিপাড়ার শুরুতেই প্রাচীন কুয়ার অবস্থান।জনশ্রুতি আছে ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা রাখাইনদের মাতৃভূমি আরাকান দখল করলে বহু রাখাইন জায়গাটি ছেড়ে নৌকাযোগে আশ্রয়ের খোঁজে বেড়িয়ে পড়েন। চলতি পথে তারা বঙ্গোপসাগরের তীরে রাঙ্গাবালি দ্বীপের খোঁজ পেয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করেন। সাগরের লোনা জল ব্যবহারের অনুপযোগী বলে মিষ্টি পানির জন্য তার এখানে একটি কূপ খণন করেন। এরপর থেকে জায়গাটি কুয়াকাটা নামে পরিচিতি পায়।সীমা বৌদ্ধ মন্দিরকুয়াকাটার প্রাচীন কুয়ার সামনেই সীমা বৌদ্ধ মন্দির। কাঠের তৈরি এই মন্দির কয়েক বছর আগে ভেঙে দালান তৈরি করা হয়েছে। তবে মন্দিরের মধ্যে এখনও আছে প্রায় ৩৭ মন ওজনের প্রাচীন অষ্টধাতুর তৈরি বুদ্ধ মূর্তি।কেরানিপাড়াসীমা বৌদ্ধ মন্দির থেকে সামনেই ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী রাখানদের আবাসস্থল কেরানিপাড়া। এখানকার রাখাইন নারীদের প্রধান কাজ কাপড় বুণন। রাখাইনদের তৈরি শীতের চাদর বেশ আকর্ষণীয়।মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ মন্দিরকুয়াকাটা সৈকত থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী সম্প্রদায় রাখাইনদের একটি গ্রামের নাম মিশ্রিপাড়া। এখানে আছে বড় একটি বৌদ্ধ মন্দির। কথিত আছে এ মন্দিরের ভেতরে আছে উপমাহাদেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধ মূর্তি। এছাড়া এখান থেকে সামান্য দূরে আমখোলা গ্রামে আছে এ

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

one × three =