বাংলাদেশ রেলওয়েতে ডেমু ট্রেন নিয়ে এসব কী হচ্ছে

0
1185

মো: আবদুল আলীম: কোন প্রকার পূর্ব পরিকল্পনা ও গবেষনা ছাড়া ৬৮৬.৫৮ কোটি টাকা ব্যয় করে চীন থেকে অতি দূর্বল ডেমু ট্রেন আনা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। যাত্রী সেবায় প্রথমদিকে এর জনপ্রীয়তা থাকলেও বর্তমান সময় এটার প্রতি যাত্রীদের আকর্ষন আর নেই। অনেক সাধের ডেমু এখন বাংলাদেশ রেলওয়ে তথা সরকারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার লোভের শিকারে বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি লাগাতার লোকসানি বিভাগে পরিণত হয়েছে। বিনিময়ে দুর্নীতির সাথে জড়িত শক্তিশালী সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। রেলের শত শত একর জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে।

দখলদাররা ভূমি অফিস থেকে টাকার বিনিময়ে নিজেদের নামে কাগজপত্র তৈরি করে রেলের বিশালাকারের জমি হাতিয়ে নিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে এসব দখলদারদের সাথে রেলওয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তাদের রয়েছে বিশেষ সম্পর্ক। যেসব কর্মকর্তাদের ওপর দায়িত্ব এসব দখলকৃত জমি উদ্ধার করা তারাই এসব দখল করে রেখেছে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। রেলওয়ের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কাজে সিন্ডিকেট গঠন করে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করার মত ঘটনা অহরহ চলছে। রেলওয়ের পুকুর জলাশয় ইজারা নিয়েও থামছে না দুর্নীতি। এদিকে টিকেট কালোবাজারি নিত্যদিনের ব্যপার।

প্রচুর টিকেট থাকা সত্যেও কাউন্টার থেকে বলা হচ্ছে টিকেট নেই। রেলওয়ের অনিয়ম দুর্নীতির তদন্ত করতে অবশেষে দুদক মাঠে নেমেছে। এখান থেকেই সরকারের এই সংস্থাটির অনিয়ম দুর্নীতির ভয়াবহতার স্পষ্টতা বুঝা যায়। যাত্রী সেবায় নিয়োজিত সরকারি এই পরিবহন সেক্টরটির যেন কোন অভিভাবক নেই।
ডেমু ট্রেন ক্রয় ও তা ব্যবহার নিয়ে রেলওয়ে বিশাল এক ধাপ পিছিয়ে গেছে। স্বল্প দূরত্বের এই ট্রেন হয়েছে এ খাতে গলার কাঁটা যা বের হচ্ছে না, ভেতরেও ঢুকছে না।

চীন থেকে ক্রয় করা ডেমু ট্রেনের বিশালাকারের লোকসান দেখে হতবাক প্রধানমন্ত্রী নিজেও। বাংলাদেশে প্রথম ডেমু কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০১১ সালে। পরে ২০১৩ সালে ২০ সেট ডেমু কেনা হয়। রেল ভবন থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে এই ২০ সেট মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল উইনিট (ডিইএমউ) বা ডেমু ক্রয়ে বাংলাদেশ সরকারকে ৬৮৬.৫৮ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। চীনের সিএনআর টানসান রেলওয়ে ভিহকিল কো. লি: থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হয়। চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন রুটে এই ট্রেন স্বল্প দূরত্বে চলাচল করে প্রথমে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও বর্তমানে এর প্রতি যাত্রীদের আর কোন আগ্রহ নেই। লোকসানে ঘানি টানতে টানতে এ ট্রেন এখন ক্লান্ত।

তথ্য অধিকার আইনের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ে (পূর্ব), চট্টগ্রাম থেকে জানা গেছে ডেমু ট্রেন সারা দেশে মে/১৩ থেকে জুন ১৮ পর্যন্ত আয় করে ১৯, ৮০, ৮৮, ৮২৫/ টাকা। জুলাই/১৮ থেকে জানুয়ারী/১৯ পর্যন্ত আয় করে ১, ৬১, ৫৪ ৩২৬/ টাকা। এদিকে এই ট্রেন রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ২০১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯, ০৬, ১৯, ৯৯২.৬৫ টাকা। রেল ভবন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে আরও জানা গেছে বিদ্যমান ডেমু সমুহের মধ্যে ১১ সেট চালূ, ৫ সেট মেইনটেনেন্স স্পেয়ার ও ৪ সেট বিশেষ মেরামতাধীন আছে অর্থাৎ বর্তমানে (১১+৫+৪) = ১৯ টি ডেমু ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

ডেমু ট্রেন আমদানি করার পর থেকে ৬৮৬.৫৮ কোটি টাকা ব্যয় করে গত ৫ বছরে মাত্র প্রায় ২১ কোটি টাকা আয় করেছে। এখানে যান্ত্রিক বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি ও এই ট্রেন থেকে লাভ-লোকসানের বিষয়টি নিয়ে কোন সঠিক পরিকল্পনা হয়নি বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা ডেমু ট্রেন আমদানি করার পর থেকে ৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও অদ্যাবধি কোন ডেমু ওয়ার্কসপ তেরী হয়নি। ফলে মেরামতাধীন ডেমু ট্রেনগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট শংকা রয়েছে। ধ্বজধরা এই ট্রেনগুলো কতটুকু শক্তি নিয়ে যাত্রী সেবা করবে ও সরকারের ৬৮৬.৫৮ কোটি টাকা ব্যয়কে কিভাবে আয়ে পরিণত করবে সে প্রশ্ন রয়েই গেল।

এ প্রশ্নের কতটুকু আশাজনক জবাব বাংলাদেশ রেল বিভাগ বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দিতে পারবে সে প্রশ্নও রয়ে গেল। ডেমু পরিণত হয়েছে ডেঙ্গুতে। এমনিতেই পরিবহনের এই খাতে অনিয়ম দুর্নীতর অভাব নেই। তার ওপর ডেমু নামক ডেঙ্গু ‘মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ’ হয়েছে। ডেমুর দৈন্যদশা দেখে সম্প্রতি জাতীয় অর্থনেতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী ডেমু ট্রেনের পরিবর্তে অন্য ট্রেন কেনার নির্দেশ দেন।

এই ট্রেন কেনার আগে সঠিক পরিকল্পনা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলে ডেমু নিয়ে এই ডেঙ্গুর মতো ভায়বহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ডেমু ট্রেন ক্রয়ে যারা উদ্যোগ নিয়েছেন ও ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে জড়িত তাদের মধ্যে এক ধরনের অসততা লুকায়িত ছিল বলে মনে করছেন সচেন মহল। দুর্নীতির সাথে জড়িতদেরকে জাতীয় স্বার্থে অবশ্যই আইনের অধীনে আনতে হবে ও জাতীর সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।

চীন থেকে এই ট্রেন ক্রয়ে কারা উদ্যোগ নিয়েছেন ও ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে কারা জড়িত সেই ব্যপারে রেল ভবনের সংশ্লিষ্ট বিভাগে তথ্য অধিকার আইনে গত এপ্রিলে আবেদন করে অদ্য পর্যন্ত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে কোন কিছু আড়াল করার পরিকল্পনা আছে কি না তা বুঝা যাচ্ছে না। ডেমু ট্রেন নিয়ে তেলেসমাতি ও সারা বাংলাদেশে রেলওয়ের ব্যপক অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে এ প্রতিবেদকের তদন্ত অব্যহত আছে। আগামি সংখ্যায় এ ব্যপারে আরও বিস্তারিত থাকছে। (চলবে)

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 + five =