বার বার কোপানো হচ্ছে কন্ঠশিল্পী জেমিকে

0
605

স্টাফ রিপোর্টার: বার বার কোপানো হচ্ছে প্রতিভাময়ী কন্ঠশিল্পী জেমি পারভীনকে। একবার কোপানোর পর চিকিৎসা নিতে গেলেই আবারো কোপানো হচ্ছে চাপাতি দিয়ে। সর্বশেষ কোপানো হয় গত ১৭ সেপ্টেম্বর। এর আগে ১৮ আগস্ট চাপাতির কোপে ফালাফালা করা হলে সেটির সেলাই খুলতে রাজধানীর স্কয়ার হসপিটালে যাচ্ছিলেন তিনি। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানীর ধানমন্ডি ২৮ নম্বর সংলগ্ন রাস্তা থেকে কালো রঙের গাড়িতে তুলে নেয়া হয় তাকে। অতপর চালু গাড়িতে মুখ চেপে ধরে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়া হয়। হাতুড়ি সদৃশ শক্ত কিছু দিয়ে হাতে, শরীরে, মাথায় পেটানো হয়। বাঁ পায়ের হাটুর নিচে এবং রানে কুপিয়ে মাংস ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এরপর প্রায় অচেতন অবস্থায় ফেলে দেয়া হয় রাস্তায়। খোদ রাজধানীর বুকেই বর্বোরিচত, লোমহর্ষক এ হামলার ঘটনায় থানা মামলা নেয়নি। কোনো গণমাধ্যমকর্মীরাও টের পাননি। কোনো সিসি ফুটেজ থাকলে হয়তো ওইদিনই ভাইরাল হয়ে যেতো। কিন্তু অসহায় জেমি পারভীন একের পর এক বর্বরোচিত হামলার শিকার হলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা গণমাধ্যমের যূতসই খোরাক হতে পারেননি। উল্টো স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে জেমি পারভীনের পরিবারকে। চাপাতির কোপে ফালাফালা হয়ে যাওয়া জেমি এখন মোহাম্মদপুরের লালামাটিয়াস্থ বাসায় অসহ্য ব্যথায় কাঁতরাচ্ছেন। বিভিন্ন সময়ে হামলার শিকার হয়ে রক্ত মাখা আলামত নিয়ে তিনি সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও শাস্তির আশায় ক্ষণ গুনছেন। সন্ত্রাসীরা শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচতে দেবে না-এই ভয় তাকে সারাক্ষণ তাড়া করছে। অবুঝ শিশুর কচি মুখ আর স্বামীর দিকে তাকিয়ে কেবলই কাঁদছেন। ব্যবসায়ী স্বামী মোহাম্মদ আলী শত অনুনয় বিনয় করেও ধানমন্ডি থানাকে দিয়ে মামলাটিই গ্রহণ করাতে পারেননি। এক রহস্যজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ধানমন্ডি থানা পুলিশ।

বিছানায় শুয়ে ঘোঙাতে ঘোঙাতে জেমি পারভীন জানান, চাচাতো ভাইয়েরা আমার সম্পত্তি গ্রাস করতে চায়। নামমাত্র মূল্যে তাদের আমি জমি লিখে দেইনি। এ কারণেই একের পর এক আমাকে হত্যার চেষ্টা। এবার আমাকে হত্যার চেষ্টা করছে চাচাতো ভাই আব্দুস সোবহান। সন্ত্রাসীরা গাড়িতে তুলে আমার মাংস কাটছিলো আর বলছিলো, সোবহানের কাছ থেকে তুই কোনো টাকা পাবি না। এই কাগজে স্বাক্ষর কর। এই নালিশ নিয়ে কোনোদিন আর ৩২ নম্বরে যাবি না। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মা’ ডাকি। এটাই কি আমার অপরাধ? আমাকে বাঁচান। ওরা আমাকে বাঁচতে দেবে না। আমার সন্তানের জন্য হলেও আমাকে বাঁচতে দিন!

এর আগেও সিরাজগঞ্জ গ্রামের বাড়িতে তাকে চাপাতি দিয়ে দু’বার কোপানো হয়। রাস্তায়ও একাধিকবার তাকে হত্যা চেষ্টা করা হয়। অথচ সময়ের উজ্জ্বল প্রতিময়ী কণ্ঠ শিল্পী জেমি পারভীন। তার সুরের মূর্চ্ছনায় লাখো হৃদয়ে বয়ে যায় আনন্দের হিল্লোল। নিজস্ব গায়কী আর স্বতন্ত্র উপস্থাপন শৈলীতে নিজেকে অনেকের মধ্য থেকে আলাদা করে নিয়েছেন। সংগীত জগতের সম্ভাবনাময় মায়াবি মুখ জেমি পারভীন। সপ্রতিভ এই আলোক শিখা পুরোপুরি জ্বলে ওঠার আগেই যেন নিভে যাচ্ছে দপ করে। তার কন্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চায় সন্ত্রাসীদের চাপাতির কোপ। নিজের নিরাপদ গৃহেই অতর্কিত হামলায় সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে ফালা ফালা করেছে জেমির শরীর। হাতে, পায়ে, পেটে, পিঠে-বাদ  নেই শরীরের কোনো স্থান। হার্মাদ জলদস্যুদেরও হার মানানো সে এক অবিশ্বাস্য নৃশংসতা। ঘটনাটি গত ১৮ আগস্ট রাতে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া শহরের পশ্চিমপাড়ায়, জেমি পারভীনের স্বামীর বাড়িতে। ঈদ এবং শোক দিবস পালন করে ওইদিনই জেমি ঢাকা থেকে উল্লাপাড়া যান। রাতে একাকী ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। হঠাৎ কলিং বেজে ওঠে। দরজা খোলার সাথে সাথে ঘরে ঢোকে ৫/৬ সন্ত্রাসী। সবার শরীরে রেইনকোট। হাতে চাপাতি, রাম দা, চায়নিজ কুড়াল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সন্ত্রাসীরা স্কচটেপ দিয়ে জেমির মুখ আটকে দেয়। এরপরই অশ্রাব্য গালাগাল, সঙ্গে এলোপাতাড়ি কোপ। জবাই করার গরুর মতোই ফিনকী দিয়ে বেরোয় রক্ত। কয়েক মিনিটের মিশন। মৃত ভেবে সন্ত্রাসীরা ড্রয়িং রুমে ফেলে যায়। যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা জিপার খুলে প্রশ্রাব করে দেয় জেমির মুখে। নিচ তলায়ই ভাড়া থাকেন সিরাজগঞ্জ-পাবনা মহাসড়কে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশের কয়েকজন সদস্য। তারা কেউ টের পাননি। পরে জেমিকে প্রথমে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতাল এবং পরে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। পরদিন ১৯ আগস্ট জেমি পারভীনের স্বামী মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে উল্লাপাড়া মডেল থানায় মামলা (নং-৪ (৮) ১৯, তারিখ ১৯/০৮/২০১৯ইং) দায়ের করেন। তাতে আসামি করা হয় জেমির চাচাতো ভাই রতন (৪৫), রূহুল আমিন (৪০), মো: মানিক (৪৬), মো: বাবুল (৪২) কে।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ঘটে যাওয়া এত বড় ঘটনা কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি। কারণ হিসেবে জানা যায়, সন্ত্রাসীরা চরমপন্থি একটি গ্রুপের সদস্য। তাদের বিষয়ে মুখ খোলার সাহস কারো নেই। অথচ কোনো সিসি ফুটেজ থাকলে এতোদিনে হয়তো জেমিকে কোপানোর দৃশ্য ভাইরাল হয়ে যেতো সিলেটের খাদিজা, ঢাকার বিশ্বজিৎ কিংবা বরগুনার রিফাতের মতো। তবে জেনির স্বজনরা কিছু ছবি তুলে রেখেছেন বীভৎসতার কারণে যা মূদ্রণ-অযোগ্য।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে জেমি জানান, চাচাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে শাহজাদপুর থানাধীন মাকরকোলা বাজারঘাটি গ্রামে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। ওরা ইতিমধ্যেই জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের অনেক সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে। বাকী সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে দিয়ে দিতে চাপ দেয়া হচ্ছে। রাজী না হওয়ায় হত্যার উদ্দেশ্যে এ হামলা। এটিই প্রথম নয়। এর আগে আরো চারবার তার ওপর নৃশংস হামলা হয়। সিরাজগঞ্জ, ঢাকা এবং গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা চালানো হয়। এ নিয়ে থানায় মামলা ছাড়াও একাধিকবার সালিশও হয়। কিন্তু কোন কিছুতেই ওদের দমন করা যায়নি। এমনকি গত ২৫ জুলাই শাহজাদপুরের গ্রামের বাড়িতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে তাকে মারধর করে জখম ও শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সিদ্ধান্তে মামলা প্রত্যাহার ও সমঝোতা হয়। পরে সমঝোতার শর্তও তারা মানেনি।

জেমি জানান, তারা ১০ বোন। তিনি নবম। সবার ছোট এক মাত্র ভাই। দুই সন্তানের জননী জেমি স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করেন। কণ্ঠশিল্পী হবার সুবাদে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের সাথে পরিচয় রয়েছে। সরাসরি দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও তিনি ও তার পরিবার আওয়ামী লীগের অনুসারী। কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের সঙ্গেই তার জানাশোনা রয়েছে। পরিবারের পক্ষে পৈত্রিক সম্পত্তি সর্বশক্তি দিয়ে আগলে রাখতে চান। এ কারণে তিনিই সন্ত্রাসীদের প্রধান টার্গেট।

এদিকে ঘটনার পর প্রায় এক মাস হতে চললেও কোনো আসামিকে গ্রেফতার করতে পারে উল্লাপাড়া থানা পুলিশ। জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উল্লাপাড়া থানার সাব-ইন্সপেক্টর জাহিদুল ইসলাম বলেন, মামলাটির তদন্ত চলছে। বাদী মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে একাধিকবার অভিযান চালিয়েও আসামিদের গ্রেফতার করা যায়নি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

fourteen − 7 =