বরগুনায় দুলাল সাম্রাজ্য ! দুলালের রাজত্বে তিনিই রাজা!

0
816

রাশেদুল ইসলাম: সময়টা ২০১৭ সালের জুনের ২২ তারিখ বিকাল ৫ টা ৩০ মিনিট। এদিন বরগুনার তালতলী এলাকার নামিশেপাড়াতে এক মর্মান্তিক ঘটনার স্বাক্ষী হয় গোটা দেশ।স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো তালতলীবাসী। সংখ্যালঘু রাখাইন সম্প্রদায়ের ৭৫ বছর বয়সী চিরকুমার নোথয় অংয়ের গৃহপালিত গরুর ডাক-চিৎকার দীর্ঘসময় ধরে না থামায় তার বাড়িতে যান প্রতিবেশি শাহআলম মীরের স্ত্রী ফাতেমা। নোথয়অং একাই বসবাস করতেন নিজের একটি দোচালা খড়ের ঘরে।তার খোঁজে ঘরে ঢুকতেই তাকে মৃত ও অর্ধগলিত অবস্থায় দেখতে পান ওই প্রতিবেশি নারী। এরপর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান দুলাল ফরাজীকে বিষয়টি জানালে তালতলী থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে বৃদ্ধ নোথয় অংয়ের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় নোথয় অংয়ের নিকটাত্মীয় জোওয়েন বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এজাহারে সন্দেহভাজন আসামিদের তালিকায় মো: শাহ আলম মীর, ইলিয়াছ মীর, আল আমিন এবং নজরুল ইসলামের নাম উল্লেখ করা হয়। কিছুদিন পরে নিহতের আরেক স্বজন আফ্রুসে মগ বাদী হয়ে মো: শাহ আলম মীর, ইলিয়াছ মীর, আল আমিন, নজরুল ইসলাম, শাহ আলম মীরের স্ত্রী ফাতেমা, আব্দুল হক দফাদার ও ছগিরকে আসামি করে সরাসরি একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন আমতলী আদালতে। পরে মামলাটি ৫০২ডি (১) আনুযায়ী স্থগিত করায় বাদী আফ্রুসে মগ বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ফৌজদারি রিভিশন মামলা দায়ের করেন। ফৌ: রিভিশন শুনানির পরে জোয়েন মগের মামলার সাথে যুক্ত করে তালতলী থানার অফির্সাস ইনচার্জকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।

বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতেপরে মামলাটি আদালতের মাধ্যমে তদন্তের দায়িত্ব পান গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবি পুলিশ মামলার প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ পেয়ে নৃশংস হত্যাকান্ডের তিন বছর পর ২০২০ সালের ১৫ই নভেম্বর ইউসুফ মুন্সী ও ইউনুচ মুন্সী নামে দুইজনকে আটক করে আদালতের কাছে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। আদালতের আদেশের পর ২দিনের রিমান্ড শেষে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন ওই দুই আসামি। হত্যার রহস্য উদঘাটনে আসামির কাছ থেকে পাওয়া যায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

মূল পরিকল্পনাকারীরা হত্যার ঘটনাকে ধামা চাপা দিতে হাঁটতে শুরু করে ভিন্ন পথে। মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য তারা ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যে ও বানোয়াট অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন। এমনকি টাকার বিনিময়ে মানুষ ভাড়া করে অপরাধীদের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনও করে তারা। এরপর কিছুটা থমকে যায় তদন্ত কার্যক্রম। প্রশাসনের চেয়েও কারা এতোটা শক্তিশালী! অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সেই অদৃশ্য শক্তিকে সবার সামনে তুলে ধরতে অনুসন্ধানে নামে অপরাধ বিচিত্রা।

সংখ্যালঘু বৃদ্ধ ৭৫ বছর বয়সী চিরকুমার নোথয় অংয়ের সাথে কি এমন শত্রুতা থাকতে পারে যার কারণে তাকে গলা কেটে হত্যা করা হলো। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সামনে চলে আসে জায়গা জমি সংক্রান্ত বিরোধের কথা। জানা যায়, প্রায় ২০ একর সম্পত্তির মধ্যে মাত্র ২ একর ৮৭ শতকের মতো জমি দখলে ছিল নিহত নোথয়অং। বাকী সম্পত্তি জোরপূর্বক দখলে  নিয়েছিল স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট। ইব্রাহিম মেম্বার, শহীদ ডাক্তার, হোসেন মুন্সী, জাকির দফাদার, পান্না মেম্বারসহ বেশ কয়েকজন এই সিন্ডিকেটের হয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন।

তারা ভুয়া ডিক্রি বানিয়ে দখলে নেয় ওই সংখ্যালঘুর সম্পত্তি। প্রতিবেশি হিসেবে শাহ আলম মীর, ইলিয়াছ মীর, আল আমিন, নজরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজনও ছিলেন এই দখল বাণিজ্যের কাতারে। জীবিত থাকতে জমি ফিরে পেতে আদালতে একাধিক মামলাও করেছিলেন নোথয়অং। কিন্তু আইনের আশ্রয় নেয়ার অপরাধে যেঢুকু সম্পত্তি দখলে ছিলেন সেটিও দখলে নেয়ার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল প্রভাবশালী সিন্ডিকেটটি। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর দ্বারস্থ হয়েও কোন সুরাহা পান নি তিনি। কিন্তু কেন? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে উঠে আসে একটি অদৃশ্য শক্তির নাম।

নোথয় অংয়ের স্বজনের দাবি, এই হত্যাকান্ডের নেপথ্যের মূল নায়ক স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান দুলাল ফরাজী। হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে আড়ালে থেকে বর্তমানে সব কলকাঠি নাড়ছেন তিনি। প্রশাসন সবকিছু জানার পরও হার মানছে তার শক্তির কাছে। দুলাল ফরাজিকে আইনের আওতায় আনলে এ হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটন হবে বলে মনে করেন নোথয় অংয়ের স্বজনরা। অনুসন্ধান বলছে, আদিবাসীদের জমি জোরপূর্বক দখলের চেষ্টায় সবসময় মগ্ন থাকেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান দুলাল ফরাজী। তিনি স্থানীয় সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর আশীর্বাদপুষ্ট।

তার নেতৃত্বেই চলে এলাকার সব অপরাধ, অপকর্মসহ দখলবাণিজ্য। নিহত নোথয়অং সংখ্যালঘু হওয়ায় তার সম্পত্তির দিকে সবসময় কুদৃষ্টি ছিল চেয়ারম্যান দুলাল ফরাজীর। তার হয়েই দখল বাণিজ্যে নামে ইব্রাহিম মেম্বার, শহীদ ডাক্তার, হোসেন মুন্সী, জাকির দফাদার, পান্না মেম্বারসহ বিশাল ভূমিদস্যু গ্রুপটি। নোথয়অং হত্যার ঘটনায় ডিবি পুলিশ ইউসুফ মুন্সী ও ইউনুচ মুন্সী নামে যে দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছিল তারা চেয়ারম্যান দুলাল ফরাজীর গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। আর একারণেই হত্যার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে শুরু হয় এতো নাটকীয়তা।

অন্ধকার জগতের কে এই দুলাল ফরাজী:

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের মূল হোতা কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের কোম্পানী উম্মা কর্পোরেশন নামে একটি কোম্পানীর সাথে চুক্তির মাধ্যমে তৎকালীন সময়ে জিয়াউর রহমান গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার অনুমতি দেয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে। আর সেই কোম্পানি থেকে ময়জুদ্দিন ফরাজী ও তার ছেলে দুলাল ফরাজী প্রচুর অর্থ নিয়ে ব্যবসা শুরু করে।

ওই সময় দেশের অনেক শত্রু তাদের বাসায় থেকে ব্যবসা করতো। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর উম্মা কর্পোরেশনের সাথে জড়িত সবাই আত্মগোপনে চলে যায়। যাওয়ার সময় ময়জুদ্দিন ফরাজী ও তার ছেলে দুলাল ফরাজী কাছে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা রেখে যায় তারা। আর ওই টাকা দিয়ে সোনাকাটা ইউনিয়নের ফকিরহাট বাজারে একচেটিয়া মাছের ব্যবসা শুরু করে বাবা-ছেলে।

কেউ সেখানে ব্যবসা করতে গেলে জলদস্যুদের হাতে তুলে দেয়া হতো তাদের, এরপর মেরে লাশ ফেলে দেয়া হতো নদীতে। ভয়ে এবং প্রমাণ না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা বলার সাহস পেত না কেউ। তাই তারা থেকে যেত ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই আসনে নির্বাচন করলে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী মতিয়র রহমান তালুকদারের পক্ষে কাজ করেন দুলাল ফরাজী।

এরপর বিএনপি ক্ষমতায় আসলে মতিয়র রহমান তালুকদারের হাত ধরে ইউপি নির্বাচনে ভোট কারচুপির মাধ্যমে জয়লাভ করে দুলাল। তারপর থেকে শুরু হয় তার অপরাধ জগতের পথচলা। নামে বেনামে দলিল বানিয়ে শুরু করেন রাখাইন সম্প্রদায়ের জমি দখল। আর এভাবে তিনি বনে যান বিপুল সম্পদের মালিক। তার স্ত্রী-সন্তানদের নামেও গড়েছেন সম্পদের অট্টালিকা।

২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে সৌদি সরকারের দেয়া এক হাজার ঘরের মধ্যে সবকটি বরাদ্দের সময় ২০ হাজার টাকা করে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণসামগ্রী গরীব অসহায়দের না দিয়ে কালোবাজারে বিক্রির তকমাও অর্জন  করেছেন তিনি। এলাকায় তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ কথা বললে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। তার রোষানল থেকে বাঁচতে পারে নি পুলিশ প্রশাসনও।

২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর পক্ষে কাজ না করলেও সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর অজ্ঞাত কারণে শম্ভুর পতাকাতলে প্রভাবশালীদের খাতায় নাম ওঠে দুলাল ফরাজীর। এক লাফে হয়ে যান উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য এবং ত্যাগী নেতা। অন্য নেতাদের ছাপিয়ে এমপির একনিষ্ঠ নেতা হিসেবে দুলাল টিআর, কাবিখাসহ সকল প্রকল্পের দায়িত্ব পান।

সাংসদ শম্ভুর আশীর্বাদে আওয়ামীলীগের সমর্থনে ২০১১ এবং ২০১৬ সালে পরপর দুইবার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয় দুলাল ফরাজী। ৬ নং ইউনিয়নকে বর্তমানে সবাই দুলাল সাম্রাজ্য হিসেবেই চেনে। তার ভয়ে অনেকেই এলাকা ছাড়া। মরণনেশা ইয়াবা ব্যবসার সাথেও দুলাল ফরাজির জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে অপরাধ বিচিত্রার অনুসন্ধানে। তার ছত্রছায়ায় সরাসরি টেকনাফ থেকে ট্রলার যোগে বড় বড় ইয়াবার চালান ঢোকে ওই এলাকায়।

তারপর বিভিন্ন মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়া হয় গোটা বাংলাদেশে। অবৈধ পন্থায় কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে বীর দর্পে দুলাল সাম্রাজ্যের পরিধি দিনদিন বিশাল আকার ধারণ করছে। তার অপরাধের নেটওয়ার্ক এতটাই শক্তিশালী যে প্রশাসন জেনেও সবকিছু সহ্য করছে নীরবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে দুলাল ফরাজির অন্ধকারাচ্ছন্ন এই ইউনিয়নের অসহায় বাসিন্দারা জানে না কবে মিলবে তাদের মুক্তি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

13 − 10 =