সাভার হাইওয়ে থানায় বসে লাখ টাকার রফাদফায় দায়সারা বক্তব্য ওসির

0
114

অপরাধ বিচিত্রা: ঢাকা আরিচা মহাসড়কে সেলফি পরিবহনের বেপরোয়া গতির চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ গেছে বেশ কয়েকজনের। তরতাজা জীবন্ত মানুষ গুলো মুহূর্তেই হচ্ছে লাশ। মৃতদেহ গুলো অনেকের কাছে সংখ্যা হলেও ভুক্তভোগী পরিবারটির কাছে সারা জীবনের জন্য বেদনার।

এক ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই প্রতিনিয়ত আরেক ঘটনার জন্ম দেওয়া সেলফি পরিবহনের বিরুদ্ধে সঠিক আইনগত ব্যবস্থা নিতেও পারছেনা ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। বেশিরভাগ সময় সাভার হাইওয়ে থানা পুলিশের সমঝোতায় পাল্টে যায় মামলার ধরন।

এমন আরেকটি ঘটনার সাক্ষী হলো সেলফি পরিবহনের চাপায় নিহত শিশু তাওহীদ (১০) এর পরিবার। বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি শেষে গ্রাম থেকে সাভারে পোশাক শ্রমিক মা-বাবার কাছে বেড়াতে এসে এমন দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল শিশুটির। সেলফি পরিবহনের বেপরোয়া গতিতে বাবার হাত ধরে থাকা তাওহীদের ঘটনাস্থলেই মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।

শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে দশটার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের গেন্ডা বাসস্ট্যান্ডের লাঙ্গলের মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

নিহত শিশুর বাবা মোস্তফা জানান, তার স্ত্রী শাপলাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি পাবনা থেকে এসে সাভারের গেন্ডা এলাকায় ভাড়া থেকে আল মুসলিম গ্রুপের পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে গ্রামে দাদা-দাদির বাড়িতে থেকে সেখানে পড়াশোনা করত। বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে গ্রামের বাড়ি পাবনা থেকে শনিবার রাতে মা বাবার কাছে সাভারে বেড়াতে আসে তিন সন্তান তাওহীদ (১০) তানজিদ(৮) ও মুসলিমা(৬)।

তবে সাভারের গেন্ডা বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি থেকে নেমে তিন সন্তানকে নিয়ে মহাসড়ক পার হয়ে বিপরীত দিকে আসতেই দ্রুত গতিতে ছুটে আসা ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জগামী সেলফি পরিবহনের একটি বাস তাদের বড় সন্তান তাওহীদকে চাপা দেয়। এ সময় মা-বাবার সামনেই বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যায় শিশু তাওহীদ।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সেলফি পরিবহনের প্রায় ১১টি বাস আটকে রাখে এলাকাবাসী। মহাসড়কে সেলফি পরিবহনের ধাক্কায় প্রতিনিয়ত একের পর এক লাশ হওয়ায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে উত্তেজিত জনতা।

খবর পেয়ে ঘন্টাখানেক পর সাভার হাইওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল খালেক এর নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে আসে হাইওয়ে পুলিশের একটি টিম। শুরু হয় সুরতহাল রিপোর্ট তৈরীর প্রস্তুতি।

এর পাশেই নারী ছেড়া ধন সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে বিলাপ করছিলেন শিশু তাওহীদের মা পোশাক শ্রমিক শাপলা বেগম।

তবে এসআই আব্দুল খালেকের কথাবার্তায় পাল্টে যেতে থাকে পরিস্থিতি। এক পর্যায়ে শিশু তাওহীদের পরিবারের পক্ষ থেকে বাবা মোস্তফা কামালের কাছে স্বাক্ষর নেওয়া হয় এই লাশের ব্যাপারে কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। শিশুটির লাশও নিয়ে যাওয়া হয় ভুক্তভোগী পরিবারের ভাড়া বাসায়।

এদিকে সেলফি পরিবহনের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে শিশুটি নিহত হওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক সাক্ষী বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তড়িঘড়ি করে শিশুর বাবা মোস্তফা কামালকে সাভার হাইওয়ে থানায় লাশ সহ নেওয়া হয়। এ সময় নিকট আত্মীয় আব্দুল আউয়ালসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও সঙ্গে ছিলেন।

শিশু তাওহীদের নিকটআত্মীয় মোঃ আব্দুল আউয়াল ১৭ ডিসেম্বর ভোর ৪ টায় সাংবাদিকদের অভিযোগ করে বলেন, তাওহীদ তার বাবার হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। মানিকগঞ্জ গামী একটি সেলফি পরিবহনের বেপরোয়া গতিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় তাওহীদ। আমরা ঘটনার বিচার দাবি করলে পুলিশ আমাদের পরামর্শ দেয় যদি মামলা করি তাহলে লাশ পোস্টমর্টেম হবে, পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তরেও দেরি হবে। তাই আমরা মালিক পক্ষের সাথে বসার ব্যবস্থা করে দেই। তাহলে লিখিত দিয়ে লাশ নিয়ে দ্রুত গ্রামে চলে যেতে পারবেন। পুলিশ কর্মকর্তার এই কথায় বাধ্য হয়ে আমরা রাজি হয়ে যাই।

তিনি বলেন, পুলিশের মোবাইল দ্বারা সেলফি পরিবহন কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের কথা বলিয়ে দেন। পরে মালিকপক্ষের রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি আমাদের প্রথমে ৫০ হাজার পরে ৭০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। আমরা রাজি না হয়ে মামলা করতে চাই।

আওয়াল আরও বলেন, কাউকে দায়ী না করে শিশুটির লাশ হস্তান্তরের জন্য চারটি পৃষ্ঠায় শিশুর বাবা মোস্তফা কামালের কাছে স্বাক্ষর নেন এসআই আব্দুল খালেক স্যার। পরে মামলার এজাহার লেখা হয়। এরপর আরো দুইটি স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এই অভিযোগ পত্রের এজাহারে আমরা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সেলফি পরিবহনের নাম উল্লেখ করতে চাইলেও পুলিশ কোনভাবেই নিতে রাজি হয়নি। আমরা একাধিক বার অনুরোধ করার পরেও তিনি অজ্ঞাত হিসেবে অভিযোগ পত্র নিয়েছেন। এটা মামলা হালকা করার একটা প্রক্রিয়া। পরিবহন মালিকের সাথে হাইওয়ে থানা পুলিশের একটি সুসম্পর্ক রয়েছে এজন্যই আমাদের গরিবের কোন কথার দাম নেই। লাশ এভাবে নিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি।

রোববার (১৭ ডিসেম্বর) দুপুর ২ টায় সাভার হাইওয়ে থানার ভিতরে পুলিশের মধ্যস্থতায় ভুক্তভোগী পরিবার ও সেলফি পরিবহন কর্তৃপক্ষের একটি আপসনামা, এজাহার ও লাশ হস্তান্তরের পত্র হাতে আসে প্রতিবেদকের। এতে শিশুটির প্রাণের মূল্য ধরা হয় ১ লাখ টাকা। শিশুটির বাবা মোস্তফা কামালের অবর্তমানে নিকট আত্মীয় আব্দুল আউয়াল ও তার বন্ধু হাজী আমজাদ আলীর কাছে ১ লাখ টাকা নগদ হস্তান্তর করে সেলফি পরিবহন কতৃপক্ষ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আব্দুল আউয়াল বলেন, সাভার হাইওয়ে থানা পুলিশ আমাদের দুই পক্ষকে বসে সমঝোতা করতে বলেন। সেলফি পরিবহনের পক্ষে ছিলেন মো. রফিকুল ইসলাম আর শিশুর পক্ষে ছিলাম আমি। এছাড়াও এসআই আব্দুল খালেক সহ আরো বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। যদিও প্রাণের মূল্য এক লাখ টাকা নয় তবুও পরিবহনের লোকজন আমাদের ১ লাখ টাকা দিতে রাজি হয় এবং আমরা তা গ্রহণ করি।

সমঝোতা পত্রে সেলফি পরিবহন মালিকপক্ষের সাক্ষী রফিকুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, শিশু তাওহীদকে কোন গাড়িটি চাপা দিয়েছে এটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পুলিশ তদন্ত করছে। এই রুটে আমাদের ১৪০ টিরও বেশি গাড়ি চলাচল করে। তারপরেও পাবলিক যেহেতু আমাদের গাড়ি আটকে দিয়েছে তাই গরিব মানুষ বিবেচনা করে আমরা মানবিক কারণে ১ লাখ টাকা দিয়েছি। আমি এখনো সাভার হাইওয়ে থানায়, এগুলো নিয়ে কাজ করছি, পরে আরো বিস্তারিত কথা বলব।

মামলার আগে পুলিশের মধ্যস্থতায় মীমাংসার ব্যাপারে জানতে চাইলে সাভার হাইওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল খালেক বলেন, আমরা মীমাংসা করব কেন.? মীমাংসা তো ওরা দুই পক্ষ করবে। মীমাংসা তো আমাদের দায়িত্ব না, আমরা মামলা নিছি, মামলা তদন্ত করব’ মামলা কোর্টে যাবে। মীমাংসা হওয়া তাদের ব্যাপার।

আপনিসহ দুই পক্ষকে নিয়ে বসে মীমাংসা করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুইপক্ষ থানার ভিতরে নাকি বাইরে বসে সমাধান করেছে, এটা তারাই জানে, আমি কিছু জানিনা।

সাভার হাইওয়ে থানায় মীমাংসার প্রমাণপত্র দিয়ে জানতে চাইলে আব্দুল খালেক বলেন, আমার সামনে কোন সমাধান হয়নি। তবে আমার সাথে অনেকেই বসে কথা বলতে পারেন। আপনি আসলে আপনার সাথেও বসে আমি কথা বলব এবং অবশ্যই একসাথে বসে কথা বলতে হবে। তারা যদি দুই পক্ষ আসে তাদের সাথে কথা বলা তো আর আমার অন্যায় কিছু না। তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি রয়েছে, আর এটা দেখানো উচিত।

এজাহারে সেলফি পরিবহনের নাম আনা হয়নি এমন অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, গাড়ি অজ্ঞাতনামা হিসেবে মামলা রেকর্ড হয়েছে। এখন সেটা সেলফি পরিবহনের হোক আর অন্য কোন গাড়ি হোক সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে, যদি সেলফি পরিবহন যুক্ত থাকে তখন তার নাম উল্লেখ করবো। সেলফি পরিবহনের নাম দিয়ে তো গাড়ি সনাক্ত করা যায় না, এই পরিবহনের অনেক গাড়ি রয়েছে, এটার নাম্বার বের করে গাড়ি সনাক্ত করতে হবে আমাকে।

ঘটনার বিষয়ে সাভার হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা  (ওসি) শেখ আবুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি দায়সারা বক্তব্য দিয়ে বলেন, ঘটনা ঘটলে বাদী বিবাদী থানায় আসবেই তারা নিজেরা- নিজেরা  আপোষ মিমাংসা করলে কারোর কিছু করার নাই তবে অনেক সময় মানবিক বিবেচনা করতে হয়। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় হাইওয়ে থানার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের বিষয় জানতে চাইলে এসব কিছু উদ্দেশ্য প্রনোদিত ভাবে করছেন বলে জানান  তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

nineteen − 17 =