যানজটে মানুষের মানসিক চাপ বাড়ছে, কর্মপরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে

0
892

যানজট কি শুধু সময়ই নষ্ট করে যাচ্ছে? শুধু সময়ই নষ্ট করছে, বিষয়টা এমন নয়। সময়ের সঙ্গে যেহেতু সব ধরনের কর্মপরিকল্পনার সম্পর্ক, তাই মানুষের মানসিক চাপ বাড়ছে, কর্মপরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে, অপরিমেয় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে, ঢাকার রাস্তায় যানজট নিজের সম্প্রসারিত রূপ ও বহুমুখী সমস্যার মাত্রা বাড়িয়েই চলেছে। এককথায় ঢাকার যানজট এখন মানুষের কর্মপরিকল্পনা এবং সময় নষ্টেই সীমাবদ্ধ নেই- আক্রান্ত করছে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য; আক্রান্ত করছে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সার্বিক অর্থনীতিকে।

সেই সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিনোদন ও সামাজিক কর্মতৎপরতাকে ব্যাহত করছে। মানুষের আবেগ, মনমেজাজ এবং সুখ-অসুখকে প্রভাবিত করছে। বলা হচ্ছে, যানজট বহুমুখী চাপ সৃষ্টিকারী বিধায় এর কারণে মানুষের শরীরে নানাবিধ জটিল রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এমন আভাসই মিলছে সম্প্রতি বুয়েটের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট : আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন কর্তৃক ২৪ মার্চ আয়োজিত বৈঠকে বলা হয়, যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে ৫ কিলোমিটার। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকায় যাত্রীদের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এই চাপ আবার কাজ করছে অন্য নানাবিধ রোগের উৎস হিসেবে। পাশাপাশি যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যানজটের পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, তাতে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। বিশেষজ্ঞরাও এ ব্যাপারে একমত। বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহর নিয়ে ২০১৬ সালের এক জরিপে বলা হয়েছে, মানুষের জীবনযাত্রার মান নিয়ে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বার্ষিক প্রতিবেদনে ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার স্থান ১৩৭তম। ভাবা যায়? ঢাকা শুধু এগিয়ে ছিল নাইজেরিয়ার বৃহত্তম শহর লাগোস, লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি ও যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের চেয়ে। ঢাকার অবকাঠামোকে যে-কোনো শহরের চেয়ে খারাপ হিসেবেও তুলে ধরা হয়েছিল জরিপে। এ তো বছর দুই আগের কথা। এতদিনে ঢাকা শহরে জনসংখ্যা আরও বেড়েছে, বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যাও। সে তুলনায় বাড়েনি পরিকল্পিত রাস্তাঘাটসহ যোগাযোগ অবকাঠামো। উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যান্য মেগাসিটির মতো ঢাকা মহানগরীও দ্রুত নগরায়ণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু যোগাযোগ অবকাঠামোসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা প্রয়োজন অনুসারে গড়ে না ওঠায় ঢাকা একটি আবদ্ধ শহরে পরিণত হচ্ছে। সেই সঙ্গে গড়ে উঠছে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সম্প্রসারিত রূপ; বৃদ্ধি পাচ্ছে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তাই বলে বস্তিবাসী নিম্নবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতি মোটেও কমছে না। কাজের খোঁজে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন শ্রেণির লোক দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকায় এসে স্থায়ী এবং অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এ শহরে যেখানে-সেখানে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, শিল্পকারখানা, আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ছোট-বড় অজস্র বহুতল শপিংমল, নানা কিসিমের স্কুল-কলেজ, কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিউটি পারলার, ফ্যাশন হাউজ, রকমারি বাণিজ্যিক অফিস ইত্যাদি। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ছাড়াই আবাসিক এলাকায় বিরাজ করছে বাণিজ্যিক আবহ। এসবের আধিক্যে ঢাকার ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীর মতো অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোও আবাসিক বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা শহরের যানজট নিয়ে একটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজট ঢাকাকে একুশ শতকের অকার্যকর নগরায়ণের সেরা উদাহরণে পরিণত করে শিক্ষাবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের কাছে এ শহরের সুনাম নষ্ট করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে ভগ্ন শহর হিসেবেও ঢাকাকে তুলে ধরেছে যানজট। ঢাকাকে এটা পরিণত করেছে এক অদ্ভুত শহরে, যা একই সঙ্গে খ্যাপাটে ও নিশ্চল। বদলে দিয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখের বেশি নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ছন্দকেও। জডি রোজেন সরেজমিন ঢাকা পরিদর্শন করে তার প্রতিবেদনে নিজের অভিজ্ঞতাকেও স্থান দিয়েছেন। বিমানবন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত স্থানের দূরত্ব সাড়ে ৮ মাইল। এ পথ পেরোতেই প্রতিবেদককে বহনকারী ট্যাক্সির সময় লাগল পাক্কা আড়াই ঘণ্টা। জডি রোজেন প্রথম দফায় বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৫ সালের মার্চে। তিনি উল্লেখ করেন, ২০০০ সালে সাংবাদিক ল্যাঞ্জভিশে লিখেছিলেন, বাংলাদেশ এমন কোনো দেশ নয়, যতটা না দুর্দশাগ্রস্ত। এটা অতিরঞ্জিত করার মতো শোনালেও যানজটে অচল ঢাকার সড়কগুলো বা সেখানে যে নিশ্চলতা, সেটা এ দুর্দশাকেই প্রমাণ করে। কেন যানজট, এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, মূল কথা হলো যানজট আসলে ঘনত্বের ব্যাপার। যখন বহু মানুষ একসঙ্গে ছোট একটি জায়গায় ঢুকতে চায়, তখন এই জটের সৃষ্টি হয়। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর ১২তম দেশ। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষ নিয়ে বাংলাদেশ এ তালিকায় সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র দেশ। হিসাবের খাতায় বাংলাদেশের আয়তন রাশিয়ার আয়তনের ১১৮ ভাগের ১ ভাগ; কিন্তু রাশিয়ার চেয়ে এর জনসংখ্যা আড়াই কোটি বেশি। বাংলাদেশের এ জনসংখ্যার ঘনত্ব সমস্যা ঢাকায় আরও ঘনীভূত হয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে ঢাকাই বাংলাদেশ- এটাই সমস্যার একটা কারণ। দেশের সরকারি কার্যক্রম, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চাকরির সিংহভাগ ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ মানুষ ঢাকায় আসছে। এই বিপুল অভিবাসনের কারণে ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ মেগাসিটি, সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোরও একটি। যে শহরে ১ কোটির বেশি মানুষ বসবাস করে, সেখানে মৌলিক অবকাঠামো নেই বললেই চলে। সঙ্গে রয়েছে আইনের শাসনের অভাব। অথচ একটি শহর বসবাসযোগ্য হতে হলে এগুলো প্রয়োজন। ঢাকার নৈরাজ্যকর রাস্তার প্রধান সমস্যাই হচ্ছে, এখানে রাস্তার পরিমাণ কম। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের বরাতে জডি রোজেন বলেছেন, ঢাকার রাস্তার পরিমাণ শহরের মোট আয়তনের মাত্র ৭ ভাগ (প্যারিস ও বার্সেলোনার মতো ১৯ শতকের শহরে সড়কের পরিমাণ ৩০ ভাগ)। ফুটপাতও একটা সমস্যা। ঢাকায় হাঁটার রাস্তা খুব কম। যা-ও আছে, তা-ও হাঁটার অযোগ্য- হকার ও গরিব মানুষের দখলে। ২০০০ সাল বা ২০১৫ সালের কথা না হয় বাদই দিলাম, ২০১৮ সালে এসে কি আমরা বলতে পারছি, ঢাকায় যানজটের মাত্রা কমেছে। উল্টোটাই হয়েছে, বরং বেড়েছে। যেমনটা এই লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি, ১২ বছর আগে ঘণ্টায় যানবাহনের গতি ছিল ২১ কিলোমিটার। বর্তমানে যানবাহনের গড়ে গতি ৫ কিলোমিটার। দিনে নষ্ট হচ্ছে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। যানজটে বছরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ হাজার কোটি টাকা! এখন প্রশ্ন- বাংলাদেশ এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে কি উদ্যোগ নিচ্ছে? ২০১৫ সালের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, ঢাকায় দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ যাত্রা (ট্রিপ) হয়। একজন মানুষ কোনো একটি বাহনে উঠে নির্ধারিত গন্তব্যে নামলে একটি যাত্রা বা ট্রিপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে হিসাবেই দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্টের হিসাব বের করে আনা হয়। যানজটের আর্থিক ক্ষতি নিয়ে একাধিক গবেষণায় ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে। এ থেকে বলা যায়, গড়ে বছরে যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। তবে সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এ ক্ষয়ক্ষতির অন্তত ৬০ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যেত- এমনটাই বুয়েটের গোলটেবিল বৈঠকে বলা হয়। যানজটের কারণে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক মানসিক স্বাস্থ্যে বড় প্রভাব পড়ছে- গোলটেবিল বৈঠকের বিশেষজ্ঞ আলোচনায় এমন বিষয়ই উঠে আসে। বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তাতে যানজটের আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যানজটের কারণ, উত্তরণের উপায়সহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, যানজট ৯ ধরনের মানবিক আচরণকে প্রভাবিত করছে। দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব থেকে শুরু করে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মতো বিষয়গুলো যানজটে প্রভাবিত হচ্ছে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসনকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মুহম্মদ সিরাজ-উল-ইসলাম বলেন, যানজটে বসে থাকলে মানসিক চাপ তৈরি হয়। নানারকম দুশ্চিন্তা ভর করে। এই মানসিক চাপ সবধরনের রোগের উৎস। চাপের কারণে নাগরিকদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, যুদ্ধংদেহী মনোভাব চলে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ দীবা বলেন, যানজটের কারণে মানসিক অশান্তি তৈরি হয়, যার প্রভাব পড়ে পরিবারসহ বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কে। ব্যক্তির কর্মদক্ষতা, কর্মস্পৃহা নষ্ট হয়ে যায়। যে চালকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালান, তাদের দুর্ঘটনা ঘটানোর আশঙ্কা বেশি থাকে। আর উচ্চমাত্রার শব্দদূষণের ফলে দীর্ঘস্থায়ী বধিরতা তৈরি হতে পারে। ২০১৬ সালে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি-২০১৬ : ঢাকা মহানগরে যানজট, শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার, মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম। যানজটের কারণ প্রসঙ্গে প্রবন্ধকার বলেন, ঢাকায় বড় সড়কের সংখ্যা হাতেগোনা। ট্রাফিক মোড়গুলো শহরের বিষফোড়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়কে অবৈধ পার্কিং, ফুটপাতের অবৈধ দখল, ভাসমান বিক্রেতাদের সড়ক দখল, যত্রতত্র যাত্রী ওঠনো-নামানো, খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়া অন্যতম। তাছাড়া দুই শতাধিক কোম্পানির অধীনে শহরের বাস-সেবা পরিচালিত হওয়ায় যাত্রী ওঠানো নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতাও যানজটের অন্যতম কারণ। সেদিন মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে একাধিক আলোচক বলেন, ঢাকা বর্তমানে নাগরিকদের শহর নয়, ‘গডফাদারদের’ শহর। ঢাকার কয়েক লাখ অনিবন্ধিত রিকশা এবং ফুটপাতের কয়েক হাজার অবৈধ হকারের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন গডফাদাররা। বাস, লঞ্চ টার্মিনালগুলো গডফাদারদের দখলে থাকায় যাত্রীসেবার বদলে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। অন্য কথায়, ঢাকার যানবাহন ব্যবস্থাকে অসুবিধাজনক বা ‘সংকটগ্রস্ত’ বললেও কম বলা হয়, দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক জডি রোজেন এমনটাই বলেছেন। তিনি ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকার স্থাপত্য ও পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আদনান মোরশেদকে উদ্ধৃত করেছেন। অধ্যাপক আদনান মোরশেদ ঢাকার এ ভিড়ভাট্টাকে ‘বড় ধরনের নাগরিক রোগ’ বলে অভিহিত করেছেন, যেটা ‘সময় নষ্ট করেই যাচ্ছে’। ঢাকার বলিষ্ঠ টেক্সটাইল শিল্প দেশটির অর্থনীতিকে গতি দিয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকার যানবাহন ও অবকাঠামোগত সমস্যা সমাধান করা না গেলে এ সফলতা ফিকে হয়ে যেতে পারে; অগ্রগতি থমকে যেতে পারে। যানজটে স্থবির রাস্তা হচ্ছে ঢাকার দুর্দশার অমোচনীয় চিত্র। এটাই হয়তো ঢাকার দুর্দশার সবচেয়ে বড় কারণ। ঢাকার যানজট নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন মন্তব্যের জোরালো প্রকাশ দেখা গেছে। আবার বুয়েটে অনুষ্ঠিত উল্লিখিত গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকরা সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমালোচনা করে বলেন, সরকারি সংস্থাগুলো শহরকে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলার পরিবর্তে ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারা অভিযোগ করেন, সরকারি এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার কাজের সমন্বয় নেই। সব বয়সি মানুষকে কোনো না কোনো কাজে বের হতে হয় বিধায় যানজটে সবাই কমবেশি ভুক্তভোগী। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যানজট নিরসনে কাজ করছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রমে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। যানজট নিরসন একক কোনো সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, বিভিন্ন সংস্থা সমন্বয়হীনভাবে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করায় যানজট বাড়ছে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা একটি সড়ক দিনের বেলায় ভালো দেখে এসেছেন, রাতের বেলায় সে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে। তিনি আরও জানান, শহরে বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলেও অনেককেই যানজটের কারণে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পেঁৗঁছানো সম্ভব হয় না। যানজট কমানো গেলে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও কমানো যেত। এখন ঢাকা মহানগরীর যানজট সমস্যা সমাধানে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তা খতিয়ে দেখা। বুয়েটে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকেও আলোচকরা ঢাকার যানজট কমাতে বাস-সেবা আরও বিস্তৃত ও উন্নত করা, রেলে যাত্রী পরিবহন বাড়ানো, ব্যক্তিগত গাড়ি কমানো, ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেন। বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সরওয়ার জাহান বলেন, ২০১৫ সালে করা আরএসটিপি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হবে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। যারা এ পরিকল্পনা করেছেন, তারা ঢাকার সমস্যা কতটা মাথায় রেখে করেছেন, তা ভাবনার বিষয়। ঢাকার যে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, তাতে বাস-সেবা মূল সমাধান। ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিষিদ্ধ না করলে এ শহর অকার্যকর হয়ে যাবে। ঢাকার যানজট সমস্যা বহুমুখী। যানজট সমস্যা নিরসনে বিপুল অর্থ ব্যয় করে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার তৈরি করা হলেও যানজট সমস্যার খুব একটা উন্নতি হয়েছে, এমনটা এখনই বলা যাচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে বলা যাবে, এমনটাও ভাবা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে সরকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। ২০১৫ সালের আগস্ট মাস থেকে আরম্ভ হয়ে এখনও চলছে, যা সমাপ্ত হলে ঢাকার রাস্তায়, বিশেষ করে যানজটে কী প্রভাব পড়ে, তা বোঝা যাবে। তখন পর্যন্ত পরিস্থিতি উন্নতির জন্য কী করা যায়, সেটাই নতুন করে ভাবতে হবে। ধারণা করা হচ্ছে, যদি জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে, তাহলে শুধু অবকাঠামোগত পরিকল্পনা করেই সুফল পাওয়া যাবে না। জনগুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যেম অন্যান্য বিভাগীয় শহরের গুরুত্ব বাড়াতে হবে জনসংখ্যার চাপ কমানোর লক্ষ্যে। এছাড়াও রাস্তা সংস্কার, ট্রাফিক মোড়গুলো উন্নত করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, হকারমুক্ত করার লক্ষ্যে জনসম্পৃক্তি এবং সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ অপরিহার্য। এ কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য গণমামাধ্যকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা, যানজট নিরসনে বিভিন্ন গবেষণা এবং আলোচনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে যেসব সুপারিশ উঠে এসেছে, তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক হতে হবে। অন্যথায় ঢাকার যানজট পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর অবস্থায় পতিত হবে। আমরা যানজটমুক্ত ঢাকা দেখতে চাই।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seven + 19 =