নতুন বছরের প্রত্যয় : নীতি থাকবে দুর্নীতি নয়

0
801

মোমিন মেহেদী
বৈশাখী রোদ আসলে হাসে মন
নতুন হাসি আজকে প্রয়োজন
এই হাসিকে রাখতে ধরে মুখে
বাজছে বাঁশি আনন্দদিন সুখে।
বাংলাদেশে পান্তা ইলিশের সংস্কৃতি চর্চার শুরুটা কে করেছিলেন তা নিয়ে অনেক রকম গল্প আছে। কেউ বলেন, সাংবাদিক শফিক রেহমান-এর কথা। আবার কেউ কেউ বলেন, চিত্র পরিচালক শহীদুল হক খানের কথা। যার কথাই উঠে আসুক না কেন পান্তা ইলিশের একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, এটাই ইলিশের প্রতি বাঙালির ভালোবাসা।

এই ভালোবাসার মূল্য দিতে তৈরি হয়েছে বাঙালির ইলিশপ্রেম। কিন্তু বাস্তবতা হলো- ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাটকা রক্ষায় অভয়াশ্রমে ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় দক্ষিণাঞ্চলের মোকামগুলো প্রায় ইলিশশূন্য। এতে বরিশালের একমাত্র বৃহত্তর বেসরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ইলিশ মোকামগুলোতে নেই কর্মব্যস্ততা। জীবিকার তাগিদে মৎস্য ব্যবসায়ীরা মাছের পাশাপাশি শুরু করেছেন মৌসুমি ফলের ব্যবসা। পদ্মা ও মেঘনায় ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ইলিশ শিকার বন্ধ থাকে। এ সময় ইলিশের আমদানি অনেকটা কমে যায়। নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকা নদীগুলো থেকে যে ইলিশ আমদানি হচ্ছে তা দিয়ে বরিশালের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশও পূরণ হচ্ছে না। যাও আসছে তার দামও আকাশচুম্বি। আর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সারাদেশে ইলিশের চাহিদা বাড়তে থাকায় দাম আরও বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমান বাজারে এক কেজি ২০০ গ্রাম বা তার বেশি ওজনের প্রতি মণ ইলিশ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে এক লাখ ১০ হাজার থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকায়। এক কেজি ওজনের ইলিশের মণ বিক্রি হচ্ছে এক লাখ টাকার উপরে। আর ৬০০ গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকায়। এছাড়াও ছোট আকারের ভেলকা ইলিশ প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায়। তবু যে বিষয়টি আমাদেরকে ক্রমশ চিন্তাগ্রস্থ করছে; তা হলো- নিষেধাজ্ঞার আগে প্রতি মণ এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৭০ হাজার টাকায়, ৬০০ গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার টাকায়। এর চেয়ে একটু ছোট আকারের ভেলকা ইলিশের প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায়। ঝাটকার প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৮ হাজার টাকা দরে। মাছের আমদানি এমন ঢিমেতালে থাকলে আগামী সপ্তাহে এর দাম আরও বাড়তে পারে। প্রতি বছর এ সময় ইলিশের আমদানির চেয়ে চাহিদা বেশি থাকে তাই দাম চড়া হয়। নিষেধাজ্ঞার সময় শেষে ইলিশের আমদানি বাড়বে তখন দামও কমে যাবে। আমদানি কম তারপরও ইলিশের দাম যা হওয়া উচিত তার চেয়ে অনেক বেশি। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নিষেধাজ্ঞা শব্দটিকে পুঁজি করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাছের দাম বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। যা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তবে আশার কথা হলো- সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে কমছে জাটকা শিকারের পরিমাণ। এ বছর নিষেধাজ্ঞার প্রথমদিকে জাটকা শিকারের খবর শোনা গেলেও বিভিন্ন বাহিনীর প্রতিনিয়ত অভিযানের কারণে এখন তারও খবর নেই।
একদিকে ইলিশের দাম বৃদ্ধি অন্যদিকে দরজায় কড়া নাড়ছে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। তাই বাঙালিয়ানা স্যালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি-ফতুয়া, শাড়ি-চুড়ি, গহনা, মাটির তৈজসপত্রসহ নানা কারূপণ্য তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন এসবের কারিগররা। নামিদামি ফ্যাসন হাউজ, বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল ও বিপণিবিতান থেকে শুরু করে ফুটপাতের দোকানেও লেগেছে বৈশাখী পণ্যের রঙিন ছোঁয়া। কদিন বাদেই ঢাকাসহ সারাদেশে জমে উঠবে সার্বজনীন এ উৎসবকেন্দ্রিক নানা পণ্যের বেচাকেনা। যা অতীতের যে কোনো সময়ের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক মন্দা না থাকায় এ বছর বৈশাখী কেনাকাটা ১৬ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তাদের টার্গেট ন্যূনতম ১৫ হাজার কোটি টাকা। যা চলমান বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে যে কোনো ইস্যুতে আকস্মিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে কিংবা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ দেখা দিলে এ লক্ষ্যমাত্রায় বড় ধরনের পতন ঘটতে পারে। যদিও আড়ং, অঞ্জন্স, লুবনান, ইনফিনিটি, লা রিভ, ইয়েলো, ক্যাটস আই ও কে-ক্রাফটসহ দেশের খ্যাতনামা ফ্যাসন হাউসগুলোর দাবি, এবার যে তালে বেচাকেনা শুরু হয়েছে তাতে যে কোনো পরিস্থিতিতেই গতবারের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বিক্রি বাড়বে। বিশেষ করে চলতি মাসের বেতনের সঙ্গে সরকারি চাকরিজীবীরা বৈশাখী ভাতা হাতে পাওয়ার পর বৈশাখী বাজার এক লাফে চাঙ্গা হয়ে উঠবে। এছাড়াও বেশকিছু ফ্যাসন হাউজ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিশেষ ছাড় দেয়ায় সেখানকার বেচাকেনা এরই মধ্যে জমে উঠেছে। এদিকে বেচাকেনা নিয়ে বড় ফ্যাশন হাউজগুলো সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও সাধারণমানের বুটিক হাউস ও তৈরি পোশাক বিক্রেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান, উচ্চবিত্তের ক্রেতারা খ্যাতনামা ফ্যাশন হাউজ থেকে বাঙালিয়ানা বৈশাখী পোশাক কিনলেও মধ্যবিত্তদের অনেকেই ভারতীয় পণ্যের দিকে ঝুঁকেছে। সে কারণে মাঝারি মানের দোকানগুলোতে দেশীয় কাপড়ে তৈরি পোশাক কম বিক্রি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সুযোগ সন্ধানী দোকানিরা ভারতীয় থ্রিপিস, শাড়ি, পাঞ্জাবি ও গহনাসহ নানা কারূপণ্যে তাদের দোকান সাজিয়েছে। তাই বৈশাখে মোট যে অংকের বেচাকেনা হবে এর বড় একটি অংশে ভারতের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। রাজধানীর গাউছিয়া, নিউমার্কেট, চাঁদনীচক, বসুন্ধরা শপিংমল, রাপা পস্নাজা ও ইস্টার্ন মলিস্নকাসহ অধিকাংশ মার্কেট ভারতীয় সিরিয়ালে ব্যবহৃত নানা নামের পোশাকে সয়লাব। সেগুলো সাজিয়েও রাখা হয়েছে দোকানের একেবারে সামনে। দোকানিরা জানান, স্টার জলসা ও জি-বাংলা সিরিয়ালের নারী অভিনেত্রীদের পোশাকের চাহিদা অনেক বেশি। তারা যে বস্নাউজ ব্যবহার করেন, যে শাড়ি পরেন ক্রেতারা সেগুলোই বেশি খুঁজছেন। দেশি পোশাক একটি বিক্রি হলে ভারতীয় পোশাক তিনটি বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে কাপড় ব্যবসায়ীদের নানা প্রস্তুতি থাকে। নানা রকম বৈশাখী পোশাকের কালেকশন তারা নিজেরা অর্ডার দিয়ে তৈরি করান। এ সময় দেশে তৈরি তাতের পোশাকও চলে অনেক। কিন্তু এবার বিক্রেতারা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ভারতীয় পোশাকের দিকে বেশি ঝুঁকেছে। কারণ দেশি যে কোনো পোশাক আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বিক্রি করে সর্বোচ্চ চার-পাঁচশ টাকা লাভ করতে পারছে। অথচ সেই একই বিনিয়োগে ভারতীয় পোশাক বিক্রি করে সাত-আটশ টাকা লাভ হচ্ছে। চড়া রঙের দেশি কাপড় সহজেই বিবর্ণ হয়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্তরা অনেকে বৈশাখী কেনাকাটায় কমদামি ভারতীয় সিল্ক, তষর ও মটকার প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক তরুণীর পছন্দের তালিকায় এখনো দেশি পোশাকই রয়েছে। শপিংমল, মার্কেট কিংবা বিপণিবিতানেই নয়, অনলাইনেও ভারতীয় পোশাকের বেচাকেনা বেশি হচ্ছে বলে জানিয়েছে এ বাণিজ্যের সঙ্গে সংশিস্নষ্টরা। অনলাইনভিত্তিক খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান ফ্যাসন লাভারস্-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারহানা হাসান ঝুমা জানান, পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে তারা প্রথম দিকে বেশকিছু নামিদামি বুটিক শপ থেকে তৈরি করা থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, ফতুয়া ও শাড়ি তুলেছিলেন। কিন্তু তাতে ক্রেতার ততটা সাড়া পাননি। তবে চলতি সপ্তাহে তাদের কালেকশনে থাকা সিংহভাগ ইন্ডিয়ান শাড়িই বিক্রি হয়ে গেছে। এছাড়াও বিপুলসংখ্যক ক্রেতা সেখানকার থ্রিপিসের অর্ডার করেছে। দেশি পোশাকের চেয়ে ভারতীয় পোশাক বেচাকেনায় লাভও বেশি। এমন নিরন্তর সম্ভাবনার বৈশাখে কেবলই মনে হচ্ছে যে, একটা সময় পহেলা বৈশাখের উৎসব আয়োজন ছিল শুধু গ্রামকেন্দ্রিক। আর এর ওপর ভিত্তি করেই গ্রামীণ নানা অর্থনৈতিক কর্মকা-েরও বিকাশ হয়। অথচ এ উৎসব এখন শহুরে মানুষও যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি জোরদার হওয়ায় সেখানে এ উৎসবভিত্তিক কেনাকাটাও বেড়েছে। সবমিলিয়ে এ উৎসবভিত্তিক বেচাকেনা ধর্মীয় বড় উৎসবের কাছাকাছিতে পৌঁছেছে। আরো আশার কথা হলো- বৈশাখ উপলক্ষে এবার শাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাকই বিক্রি হবে আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার। এর সঙ্গে গহনাসহ বিভিন্ন কারুপণ্য বিক্রির টার্গেট দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এসব কাজে যত লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে তা হিসাব করা হলে এই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিমাণ আট থেকে দশ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।
সম্ভাবনার বৈশাখ, আনন্দ-উল্লাস আর ভালোবাসার বৈশাখে ইলিশের দাম বাড়–ক, জমে উঠুক দোকান-পাট-বাজার-হাট। কেবল যেন না ঘটে নারী নির্যাতন, নীপিড়নের ঘটনা। যেন আবারো কোন নারীকে হারাতে না হয় বছরের প্রথম দিন নিজের সর্বোচ্চ সম্মান। সেই প্রত্যয়ে আগমন ঘটুক বৈশাখের। আমরা রঙ্গিন দিনে নতুন করে রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সাজাবো বিনয় আর ভালোবাসায়। যেখানে- যেদিনে নীতি থাকবে, দুর্নীতি নয়…

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

five + 17 =