সর্বনাশ-ডিজিটাল জুয়ার আসর ই-ভ্যালি

0
596

মো: আহসানউল্লাহ হাসান: গ্রাম্যভাষায় একটি কথা আছে-‘দেখাইলো মুরগী খাওয়াইলো ডাইল’ অর্থাৎ একলোক মেম্বার নির্বাচিত হওয়ার পরে তার বাড়িতে খাওয়ার জন্য গ্রামবাসীকে দাওয়াত করে নিয়েছে। খাবার দেয়ার আগে মেম্বার তার ভাব-ভঙ্গিমা এমন ভাবে প্রকাশ করেছে যেন তিনিই সবচেয়ে উন্নতমানের খাবার খাওয়াবেন। কিন্তু যখন খাবার পরিবেশন করা হলো তখন ভাতের সাথে পাঁচমিশালী সবজি আর ডাল ছাড়া সেই মুরগীর অস্তিত্ব কেউ খুজে পেলো না। তখন গ্রামবাসী এটাকে মেম্ববারের প্রতারনা হিসেবেই আখ্যায়িত করেছিলো। অর্থাৎ যখন কোন বিষয়বস্তু যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, ঠিক সেই ভাবে তাহার প্রতিফলন বা বাস্তবায়ন না করাই হচ্ছে প্রতারনা। আর এই প্রতারনা এখন আমাদের দেশে একধরনে চমকপ্রদ পেশায় পরিনত হয়ে গেছে। কেউ নিজে প্রতারনা করে, আবার কেউ অন্যকে প্রতারনা করতে সহযোগিতা করে। তবে দুজনেরই টার্গেট থাকে আরেক জনের অর্থ-সম্পদ হাতিয়ে নেয়া। এই যেমন ডেসটিনির প্রতারক রফিকুল আমিন বছরের পর বছর নানা প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে সর্বশান্ত করেছে সাধারন মানুষকে। আর অর্থের বিনিময়ে এই কাজে ডেসটিনিকে সহযোগিতা করেছে তৎকালীন সময়ের প্রভাবশালী মন্ত্রী, আমলা, কামলা সহ নানান জন। বর্তমান সময়ে দেশের আলোচিত প্রতারক সাহেদ। সাহেদের প্রতারনা ফাঁস হওয়ার পরে তাকে আশ্রয় প্রশ্রয় বা সহযোগিতাকারী কিছু ভিআইপি-সিআইপি মুখের দেখা মিলেছে মিডিয়ার কল্যানে। ডেসটিনির চাইতে সাহেদের প্রতারনার কৌশলটা ছিলো সম্পূর্ন আলাদা।

তবে দুজনেই হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সভ্যতার বিবর্তনে এসব প্রতারকদের কৌশলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সাধারন মানুয়ের হাতে এখন স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ কম্পিউটার, ইন্টারনেটের কল্যানে পুরো পৃথিবীটাই তাদের হাতের মুঠোয়। আর এই সুযোগটিকে পরিকল্পনা মাফিক  কাজে লাগিয়েছে ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা মো: রাসেল।

ইন্টারনেটে কেনাকাটার জন্য ইভ্যালি অনলাইন সপিংমল নামের ওয়েবসাইট খুলে বিভিন্ন ব্রান্ডের পন্যের ছবিতে মুল্য সংযোজন করে ১০০ থেকে ১৫০ পারসেন্ট পর্যন্ত ক্যাশব্যাক নামক অফার দিয়ে মানুষকে ফাঁদে ফেলছেন এই সাইবার প্রতারক। হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ইভ্যালি থেকে ১ লাখ টাকার পন্য কিনলে ১ লাখ টাকাই ক্যাশব্যাক, আবার কোন কোন অফারে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ক্যাশব্যাক। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব। এসব প্রশ্নের উত্তর খুজতে  দীর্ঘ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কিছু চমকপ্রদ তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ই-কমার্স অর্থাৎ ইন্টারনেট ভিত্তিক বানিজ্যিক কার্যক্রম সারা বিশে^ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। প্রতি মুহুর্তেই এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, অ্যামাজোন, আলীবাবার মতো অসংখ্য ওয়েবসাইট তাদের পন্য সেবা বিপণন করতে মানুষের ড্রইংরূমে ঢুকে গেছে। স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার হাতে নিয়ে গু-গুলে ক্লিক করলেই চোখের সামনে চলে আসবে এদের বানিজ্যিক কার্যক্রম। ই-কমার্সের কল্যানে এবছর ঘরে বসেই কুরবানী গরু কিনেছে অনেকে।

সারা বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও অনলাইন ভিত্তিক বানিজ্যিক কার্যক্রম দিনে দিনে ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এখানকার মানুষ প্রতিনিয়তই প্রতারিত হচ্ছে। কখনো কখনো টাকা দিয়েও সেবা বা পন্য পাওয়া যাচ্ছে না, আবার পাওয়া গেলেও তাহার গুণগতমান খুবই খারাপ। আবার কোন কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার যাদের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়, তারা অনেকটা বুক ফুলিয়ে সবার সামনেই মানুষকে সর্বশান্ত করে চলছে।

যেন দেশে আইন কানুন বলতে কিছুই নেই। এদের মধ্যে ইভ্যালি অনলাইন শপিংমল অন্যতম। ইভ্যালিকে একধরনের জুয়ার বোর্ড বা ডিজিটাল ক্যাসিনো বলেই মনে করেন ই-কমার্স সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এই খেলার প্রথম বাজিতে দর্শকই জিতবে, কিন্তু শেষ বাজিতে ইভ্যালি জিতবে এটাই হচ্ছে রহস্য। একারনেই দেড়শ পারসেন্ট পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার। মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, মোবাইল ফোনসেট, টেলিভিশন ইত্যাদির যেকোন পণ্য একটি কিনলেই অস্বাভাবিক হারে ‘ক্যাশব্যাক’।

অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য কিনে সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি অর্থ ফেরত। এমন অফারে লাভবানও হয়েছেন অনেকে। আবার অনেকেই আছেন লাভের অপেক্ষায়। কারন এখানে টাকা জমা দিয়ে ৪৫ থেকে ৬০ কর্মদিবস পন্যের জন্য অপেক্ষা করার নিয়ম রয়েছে। কোম্পানীটির নিজস্ব উৎপাদনের কোন পন্য নেই। বিভিন্ন ব্রান্ডের কোম্পানীর পন্য এই জাদুকরী সিস্টেমেই বাজারজাত করে আসছে ইভ্যালির সিইও মো: রাসেল।

১৪মে-২০১৮ যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে মাত্র ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধন দেখিয়ে ইভ্যালি ডটকম নামে নিবন্ধন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটি অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা এখন ৬০লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন কোটি টাকার উপরে পন্য বিক্রির অর্ডার পাচ্ছেন তারা।

তাজিজুল ইসলাম নামে এক যুবক তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেন, ১০০% ক্যাশব্যাকে ২৯ হাজার টাকায় একটি ওয়াল্টন স্মার্ট টিভি কিনেছিলাম। টিভিটা পেয়েছিলাম দীর্ঘ ৭৬ দিন পর। অবশ্য ক্যাশব্যাকের ২৯ হাজার টাকায় ক্যানন-৭০০ডি ক্যামেরা কিনেছি, তবে ক্যামেরাটি ২৪ দিনের মধ্যেই পেয়েছিলাম। তার মানে ইভ্যালিতে আমি ক্যামেরাটি ফ্রিতেই পেয়েছি, ইভ্যালি আছে বলেই যা সম্ভব।

তাজিজুল ইসলামের কথার প্রেক্ষিতে জানা গেছে, ওয়ালটন শো-রুম থেকে ওয়াল্টন স্মার্ট টিভিটি কিনতে হলে ২৯ হাজার টাকাই লাগতো, কিন্ত ইভ্যালিতে এটার দাম পড়েছে ১৪ হাজার ৫শ টাকা, আর ক্যামেরার দাম পড়েছে ১৪ হাজার ৫শ টাকা। এটা কিভাবে সম্ভব? তবে জুয়ার আসর হলেই কেবল সম্ভব। এই খেলার প্রথম বাজিতে তাজিজুল ইসলাম অসম্ভব পরিমানে লাভের মুখ দেখেছে। আর ইভ্যালির যথেষ্ট লোকসান হয়েছে। আর এটা যদি সত্যি না হয়, তাহলে ওয়ালটনের পন্য ব্যবহারকারীরা জীবনভর আইক্কাওয়ালা বাঁশ খেয়েছে।

আবার মো: আল আমিনের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানা গেছে, “বাকির নাম ফাঁকি” লোভে পড়লে মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পায় আর ঠিক তখনই মানুষ এসব প্রতারনার ফাঁদে পা দেয়। জুয়ার আসরেই মানুষ তার পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে বাজি ধরে।

১০০ পারসেন্ট ক্যাশব্যাক দিয়ে অভিনব কৌশলে গ্রাহক সংখ্যা বাড়াচ্ছে ইভ্যালি। একটা সময় শেষে এমন একটি ধামাকা অফার দিয়ে দিবে যেখানে সব গ্রাহকই হুমড়ি খেয়ে ঐ অফারটি গ্রহন করবে। অর্থাৎ ইভ্যালির গ্রাহক সংখ্যা যখন কোটির উপরে ছাড়িয়ে যাবে, তখন ২০ হাজার টাকা মুল্যের একটি ছোট অফার যথেষ্ট। তিনমাস পরে পন্য দেয়ার শর্তে গ্রাহক প্রতি ২০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিতে পারলেই ইভ্যালির সন্ধান আর কেই খুজে পাবে না।

এই যেমন স্বর্ণের ভরি ২০ হাজার টাকা এই জাতীয় একটি ধামাকা অফারের মাধ্যমে সমস্ত লোকসান বা বিনিয়োগের টাকা সহ শতগুণ বেশী টাকা কোম্পানীর হাতে চলে আসবে। ১কোটি গ্রাহকের নিকট থেকে ২০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিলে কোম্পানীর হাতে আসবে ২০ হাজার কোটি টাকা। এবার কোম্পানী বন্ধ হলে ডেসটিনি মতোই গ্রাহকের ক্ষতি হবে।

ইভ্যালির এমন অভিনব বিপণন সিস্টেম নিয়ে সম্প্রতি দেশের একাধিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হলেও সরকারী সংস্থাগুলোকে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বরং ইভ্যালির কার্যক্রম আরো বেশী গতিশীল হয়েছে। তাহলে কি ওই প্রতিবেনটি মিথ্যে ছিলো এমন প্রশ্নই ঘুরে ফিরে সমানে চলে আসছে। 

সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী তানজীব-উল-আলম ওই প্রতিবেদনে বলেছিলেন, ‘ইভ্যালির কার্যক্রমের ধরন অনেকটা এমএলএম কোম্পানির মতো। এমএলএম কোম্পানিগুলোর প্রতারণার চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, ইভ্যালিও তাই করছে। ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। এখানে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ রয়েছে।

ইভ্যালির গনমাধ্যম কর্মকর্তা বলেন, ‘১০০ টাকার পণ্যে ১০০ টাকাই ক্যাশব্যাক দেওয়া হয়, এই টাকা আবার ইভ্যালির ব্যালেন্সেই যোগ হয়। পরে এই টাকা দিয়ে গ্রাহক অন্য কোন অফারের পন্য ক্রয় করতে পারেন, কিন্তু এক্ষেত্রে কোন ক্যাশব্যাক দেয়া হয় না। প্রথম অফারে ক্যাশব্যাক দেয়ায় কোম্পানীর একটি নিদিষ্ট পরিমান অর্থ লোকসান হয়। তবে গ্রাহক যখন ক্যাশব্যাকের টাকা দিয়ে অন্য পণ্য ক্রয় করে, তখন তার লাভ থেকেই কোম্পানী লোকসান পুষিয়ে নেয়।’

ইভ্যালি সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, কোম্পানির পরিশোধিত মুলধন ৫০ হাজার টাকা এবং অনুমোদিত মূলধন ৫লাখ টাকা। ১০টাকা মূল্যমানের এক হাজার শেয়ারের মালিক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল। আর চার হাজার শেয়ারের মালিক তাঁর স্ত্রী কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন। অর্থাৎ পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন মোহাম্মদ রাসেল আর ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন শামীমা নাসরিন। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পরিসংখ্যান অনুসারে আগামী বছর দুয়েকের মধ্যে গ্রাহক সংখ্যা কোটির উপরে ছাড়িয়ে যাবে। তখনই হবে আসল খেলা……….

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

sixteen − ten =