“বছরে চুরি হয় কয়েক কোটি টাকার জ্বালানি তেল” চট্টগ্রামে রেলের তেল লোপাটের ঘাটি সিজিপিওয়াই

0
325

ইয়ার্ড নিজস্ব প্রতিবেদক : চট্টগ্রামের পাহাড়তলী সিজিপিওয়াই ইয়ার্ডে গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধ একটি চক্র রেলের কোটি কোটি টাকার জ্বালানি তেল লোপাট করছে। দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী প্রায় প্রতিটি ট্রেন থেকে চুরি করা হয় জ্বালানি তেল। চট্টগ্রাম বন্দর ও পাহাড়তলীসহ দেশের প্রায় প্রতিটি লোকোসেডের পাশাপাশি ঘাটে ঘাটে চলে তেল চোরাকারবারিদের কর্মকান্ড।

 শুধু তেল নয়, রেলওয়ের কোটি কোটি টাকার লোহাসহ নানা সরঞ্জামও লোপাট করছে এই সংঘবদ্ধ চক্র। যারা লোকোসেড থেকে ট্রেনের নানা যন্ত্রাংশ লোপাট করে। নগরীর বন্দর লোকোসেডে দুদকের অভিযানের পর চুরি কিছুটা থামলেও নতুন করে আবার শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে সরকারের লাভের গুড় পিপঁড়ায় খেয়ে ফেলছে বলে মন্তব্য করছেন রেলওয়ের সচেতন মহল। রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলওয়ে দুটি পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত। পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চল। চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট, চাঁদপুরসহ বিস্তৃত এলাকা নিয়ে গঠিত রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ১২৭৩.৩৮ কিলোমিটার মিটারগেজ এবং ৩৪.৮৯ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ মিলে ১৩০৮.২৭ কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে। এই রেললাইনের উপর দিয়ে সুবর্ণ এক্সপ্রেস, সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, মহানগর গোধূলী এক্সপ্রেসসহ প্রতিদিন ৪৮টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। মেইল এক্সপ্রেস ও কমিউটার ট্রেন মিলে চলাচল করে ৬৬টি। কন্টেইনার এক্সপ্রেস চলে ৮টি।

 এর বাইরে পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মাঝে চলাচল করে এমন ৩২টি আন্তঃনগর ট্রেনও রয়েছে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, বন্দর, ঢাকা, লাকসাম, আখাউড়া, কুলাউড়া, সিলেট, কেওয়াটখালি (ময়মনসিংহ), খুলনা, ঈশ্বরদী, পার্বতীপুর, লালমনিরহাট ও বোনারপাড়ায় ১৪টি লোকোসেড রয়েছে। এগুলোকে রেলওয়ের বেসও বলা হয়। দেশে চলাচলকারী প্রতিটি ট্রেনই কোনো না কোনো বেসের আওতায় চলাচল করে। লোকোসেডগুলো ট্রেনের ফাইনাল ডেস্টিনেশন। এখানে ট্রেনের ইঞ্জিনে জ্বালানি তেল বোঝাই করা হয়। একেকটি ট্রেনে প্রতিটি ট্রিপের জন্য গড়ে এক থেকে দেড় হাজার লিটার পর্যন্ত তেল বোঝাই করা হয়। এই তেলের একটি অংশ প্রতিদিন লোপাট হয়। রেলওয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ট্রেনের গতির ওপর জ্বালানি তেলের ব্যবহার নির্ভর করে। ট্রেনের গতি যত বাড়ে তেল খরচও তত বেশি হয়। অপরদিকে বগির সংখ্যা বেশি হলে কিংবা পণ্যবাহী ট্রেনের ক্ষেত্রেও জ্বালানি তেল ব্যবহার বাড়ে।

 সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের চট্টগ্রাম থেকে লাকসাম পর্যন্ত ১২৯.৬০ কিলোমিটার এলাকায় এক ধরনের গতিতে ট্রেন চলে। লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত এলাকায় চলে পৃথক গতিতে। আবার আখাউড়া থেকে ঢাকা পর্যন্ত এলাকায় চলাচল করে ভিন্ন গতিতে। তেল সাশ্রয় করে লোপাট করার জন্য ট্রেনের গতি কমিয়ে রাখা হয় বলে সূত্রের অভিযোগ। এক্ষেত্রে শুধু যাত্রীবাহী ট্রেন নয়, পণ্যবাহী মালগাড়িগুলোও একই কারণে কম গতিতে চলে। রেলওয়ের অধিকাংশ ইঞ্জিন ইলেক্ট্রোমোটিভ ডিজেল (ইএমডি)। আমেরিকার তৈরি টু স্ট্রোকের ইঞ্জিনগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও প্রতি ঘণ্টায় ১১ লিটার ডিজেল পোড়ায়। ট্রেনটি যখন সর্বোচ্চ গতিতে (৮ নচ) চলে তখন এটি প্রতি মিনিটে ১০ লিটার করে তেল পোড়ায়। চট্টগ্রাম থেকে ৩২৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছতে এই ধরনের একটি ট্রেন গড়ে প্রায় ১ হাজার লিটার তেল পোড়ায়। এছাড়া বাংলাদেশে আলকো লোকোমোটিভ নামের ফোর স্ট্রোকের একটি ইঞ্জিনও রয়েছে। এই ইঞ্জিন কোথাও এমনিতে দাঁড়িয়ে থাকলে ঘণ্টায় ২২ লিটার ডিজেল ব্যবহার করে। আবার ৮ নচ গতিতে চললে মিনিটে ৯ লিটার করে তেল পোড়ায়। বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার তেল ব্যবহার করে। পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে রেল জ্বালানি তেল ক্রয় করে।

 এই তিনটি তেল বিপণন কোম্পানি রেলের কাছে কয়েকশ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। রেলওয়ের কেনা এই তেল বিভিন্ন লোকোসেডে ট্রেনে বোঝাই করা হয়। আর এ সময় থেকে গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত নানা ধাপে তেল চুরির ঘটনা ঘটে। লোকোসেডসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধ চক্র কোটি কোটি টাকার জ্বালানি তেল লোপাট করে। রেলওয়ে কর্মচারীর পাশাপাশি পাহারা দেয়ার দায়িত্বে থাকা আরএনবির সদস্যরাও এই চক্রের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের পাহাড়তলী সিজিপিইয়ার্ডেও মাস্টার আবদুল মালেক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রেনযোগে কোটি কোটি টাকার পণ্য পরিবাহিত হয়। নগরীর হালিশহরে চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) থেকে এই কর্মযজ্ঞ নিয়ন্ত্রিত হয়। রেলওয়ের আয়ের বড় একটি অংশের যোগানে জড়িত এই ইয়ার্ড। কিন্তু এখান থেকে নিয়মিত তেল ও যন্ত্রাংশ পাচার করা হচ্ছে। যা প্রতিরোধ করার সাধ্য কারো নেই। কারণ এই চক্রের সাথে রেলের অনেক উচু পদেও কর্তারাও জড়িত বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, বছরখানেক আগে দুদক এই ইয়ার্ডে অভিযান পরিচালনা করেছিল।

 ওই ঘটনার পর এক যুগের বেশি সময় ধরে ওই ইয়ার্ডে কাজ করা রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) বেশ কয়েকজন সদস্যকে বদলি করা হয়েছিল। দুদকের অভিযানের পর থেমে গিয়েছিল তেল পাচারসহ সব ধরনের অপকর্ম। কিন্তু বছর না ঘুরতেই আবারো শুরু হয়েছে তেল পাচার ও যন্ত্রপাতিসহ নানা জিনিসপত্র লোপাটের অপতৎপরতা। এ বিষয়ে রেলওয়ে সদর দপ্তরে একাধিক পত্র দেয়া হয়েছে। কিন্তু চক্রটির অপতৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তাও এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, জিএম সাহেব তো অক্টোবরে অবসরে যাবেন। ফলে রেল নিয়ে তাঁর তেমন মাথাব্যাথাও নেই। বরং তিনি নিজেও নানা অনিয়মের সাথে যুক্ত। এ অবস্থায় রেলে তেল ও যন্ত্রাংশ চুরির ঘটনা ঘটছে নানাভাবে। যা প্রতিরোধের চেষ্টাও নেই। রেলের গতি কমিয়ে তেল সাশ্রয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি ঠিক নয়। রেললাইনের অবস্থা ভালো নয়। অনেক ব্রিজ পুরনো হয়ে গেছে। এসব ব্রিজের উপর দিয়ে ৭০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চালানো সম্ভব হয় না। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে ট্রেনের গতি কমিয়ে রাখতে হয়। ডাবল লাইন চালু এবং ব্রিজগুলোর সংস্কার |

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 × four =